দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনে অনড় ক্ষমতাসীনরা। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে বিপরীতমুখী দুপক্ষকে এক মেরুতে আনতে বেশ কিছুদিন ধরেই তৎপরতা চালাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকারকে চাপে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কেউ-ই তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেনি। সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও তৎপরতা পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানী ঢাকা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে এ মুহূর্তে আলোচনায় রয়েছে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন। ইইউর অনুসন্ধানী মিশন তিন দিন ধরে সরকার, রাজনীতিক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, বিদেশি কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে। তাদের ফোকাস বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তারা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইছে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করার সহায়ক পরিবেশ বাংলাদেশে রয়েছে কি না। বর্তমান বিরাজমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে সেখানে ইসি, পুলিশ ও সরকারের ভূমিকা কী হবে। তবে এখনো তারা কোথাও তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার, সংসদ বিলুপ্ত কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে কথা বলেনি।
ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ইইউর আগ্রহ রয়েছে। তারা অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান।
ইইউ দূতের সঙ্গে বৈঠকের পর গত সোমবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার, সংসদ বিলুপ্ত, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বা সংলাপ নিয়ে আলোচনা হয়নি। ইইউ অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়।’
ইইউ মিশন আগামী ১৫ জুলাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবে। এর আগে গত সোমবার ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি এবং উপ-রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ড স্পেনিয়ের। সেদিন সন্ধ্যায় ইইউ দূতের বাসভবনে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে পর্যবেক্ষক দল বৈঠক করে। এতে অংশ নেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। ওই বৈঠকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে স্বাধীন ইসি গঠনসহ সরকারের নানা পদক্ষেপ ইইউ মিশনের কাছে তুলে ধরেছেন। দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনগুলোর কথা বলা হয়। ইইউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কিছু জানতে না চাইলেও আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের জানিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সরকার নয়, আদালত বাতিল করেছেন। তাই সংবিধান মেনেই নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচনের সময় সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, কূটনীতিকদের কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। বিএনপি যাদের কাছে ধরনা দিচ্ছে তারা সংবিধানের বাইরে এক শব্দও উচ্চারণ করবেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়েছে। মূলত বিএনপি নেতা তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ। নির্বাচন করে বিএনপি থেকে কোনো একজন জাতীয় নেতৃত্বে আসুক—তা সে চায় না। এ কারণেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করছে। অতীতে তাদের আন্দোলন মানেই খুন-হত্যা-আগুন সন্ত্রাস। এজন্য জনগণ সম্পৃক্তও হয়নি। তাদের এই আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারায় এই একদফাও ফানুসে পরিণত হবে।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনকে একটি আইনি ভিত্তি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তার সঙ্গে সংগতি রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব উন্নয়ন সহযোগী দেশ বাংলাদেশেও একটি ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা অসাংবিধানিক কোনো ব্যবস্থার প্রতি কোনো সময়েই কোনো বন্ধুপ্রতিম দেশ তাদের অবস্থান নেবে না—এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হবে।’
এদিকে গতকাল মঙ্গলবারও ইইউ দল নির্বাচন কমিশনসহ ভোট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি গুরুত্ব পেয়েছে।
গতকাল গুলশানে ইইউ প্রতিনিধিরা ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকের পর ফোরামের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী জানান, ‘ইইউ বিগত নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, সেটিও জানতে চেয়েছেন। আমরা অতীত ও বর্তমানের সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়েছি। তারা বলেছেন, আগামী নির্বাচনের আগে ইইউ পর্যবেক্ষক মিশন আসবে। তারা আশা করেন, আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। তবে সংবিধানে নেই এমন কোনো কথা তারা বলেননি। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে কিছু তারা জানতে চাননি।’
এদিকে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে সবচেয়ে বেশি চাপে রাখা উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুদেশ যুক্তরাষ্ট্রও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এখন পর্যন্ত সরাসরি কিছু বলেনি। তাদের নতুন ভিসা নীতিসহ প্রকাশ্য-নেপথ্য সব আলোচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।
তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ কালবেলাকে বলেন, ‘বিদেশিরা সবসময়ই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছেন। বিশেষ করে মানুষ যেন ঠিকমতো ভোট দিতে পারে, সেটার ওপরই তারা জোর দিচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার তো বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোরই একটি জাতীয় ইস্যু। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এটা ঠিক করতে হবে। সেটা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনেই আমরা আছি। এটাতে বাইরের কারও কিছু করার নেই এবং এটা তাদের কাজও না। সরকার দাবি না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা সে দাবি আদায় করব।’
দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা কালবেলাকে বলেন, ‘বিদেশিরা বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে চারটি মাত্র নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এ চারটি নির্বাচনের সময় কোনো দলীয় সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল না। নির্দলীয় সরকার ছিল। সুতরাং আমরা যদি হিস্ট্রি দেখি যে, এটা (তত্ত্বাবধায়ক) অটোমেটিক্যালি চলে আসে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। নির্বাচনের সময় আমেরিকা বা ব্রিটেনের বাস্তবতা যেটা, আমাদের বাস্তবতা কিন্তু সেটা না। ওরা নির্বাচনে কারচুপির কথা চিন্তাও করতে পারে না। কেউ সেই চিন্তা করলেও সেখানে বিচার বিভাগ, পুলিশ-প্রশাসন সবাই মিলে ওদের সাহায্য করতে যাবে না। ওদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এতটাই শক্তিশালী যে, এ ধরনের নোংরামি করলে তারাই প্রতিহত করবে। অর্থাৎ তাদের আর আমাদের বাস্তবতা একেবারেই আলাদা। সুতরাং আমাদের বাস্তবতায় কোনটা (নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা) অ্যাপ্লাই করে সেটা বোঝার জন্যই বিদেশিদের এত দৌড়ঝাঁপ।’
মন্তব্য করুন