নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার চেষ্টা, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক থাকা, কিশোর গ্যাং নির্মূলসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা নিয়ে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরলেন জেলা প্রশাসকরা। ঢাকায় চার দিনের ডিসি সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে এসব নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরা। গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে এবারের ডিসি সম্মেলন। সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকদের প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত কর্মকাণ্ড যেমন রয়েছে, তেমনি সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ডিসিদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এই চাপ বা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পারলে সাধারণ মানুষ মাঠ প্রশাসনের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার (৩ মার্চ) জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধন করেন। আর গত রাতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ডিসি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা। এই অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে ৩ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা নৈশভোজে অংশ নেন।
প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক না হলে সরকারের কোনো পদক্ষেপেই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সম্মেলনে তাদের দায়িত্বের বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কারণ জেলা পর্যায়ে তারা সরকারের সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করলে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘যারা বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক হয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে যোগ্য কর্মকর্তা। সুতরাং তারা সরকারের যে কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নে সক্ষম হওয়ার কথা। তারা সব সময় চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করেন। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশনা ডিসিরা পেলেন সেগুলো তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিসিরা যেসব প্রস্তাব তুলেছেন সেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ যাছাই-বাছাই করে সম্ভব হলে বাস্তবায়ন করে থাকে। তবে সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।’
গতকাল শেষ দিন সম্মেলনে কয়েকটি কার্য-অধিবেশনে ৫১টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সব মিলিয়ে চার দিনে ৫৬টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩৫৬টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন অধিবেশনে প্রস্তাবগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের বাইরেও জেলা পর্যায়ের নানা সমস্যা তুলে ধরেন ডিসিরা। এসব সমস্যা সমাধানে ডিসিদের সহায়তা চান মন্ত্রীরা।
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘জেলায় জাতীয় সরকারের একমাত্র প্রতিনিধি ডিসি। বলা যায় তিনিই জেলার সরকার। সুতরাং রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশনা ডিসিকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। কারণ জেলার সব কিছুর সঙ্গে তিনি জড়িত। ৪০টিরও বেশি কমিটির সভাপতি একজন ডিসি। ফলে তার দায়িত্বও বেশি।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘রমজান সামনে রেখে যে কোনো ধরনের খাদ্য মজুত ও ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। কোথাও যেন ভোক্তাদের হয়রানির শিকার হতে না হয়।’
সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে সঠিকভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কি না তা সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এটি অনুসরণ করতে হবে।’
কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন কিশোর গ্যাং অন্যতম বড় সমস্যা। প্রায়ই এদের উৎপাত দেখা যায়। পড়ালেখা করা ছেলেমেয়েরা কেন এসবে জড়াবে? এটা সবার দেখতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাইকে নজরদারি বাড়াতে হবে। ছেলেমেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় কি না, সেটা নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারায় জেলা প্রশাসকদের ধন্যবাদও দেন প্রধানমন্ত্রী।
আইন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অধিবেশনে মন্ত্রী আনিসুল হক মামলা জটের বিষয়ে ডিসিদের সহযোগিতা চান। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মামলা জট কমাতে ডিসিদের সহযোগিতা চেয়েছি।
প্রতি মাসে জেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা কোর কমিটির সভা করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সেইসঙ্গে ইয়াবা ও এলএসডির মতো মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলারও নির্দেশ দেন তিনি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কামাল বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিসিদের অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করেন। বিশেষ করে রোজার আগে তারা যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহযোগিতা করেন।’
নদীপথে যেন যত্রতত্র বালু উত্তোলন না করা হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ডিসিদের যখন প্রয়োজন, তখনই নিরাপত্তা বাহিনী তাদের পাশে থাকবে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে অধিবেশনে ডিসিদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আগে নিজের ঘর দুর্নীতিমুক্ত করুন।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অনেক সময় ডিসিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকে। ডিসিদের আমরা বলেছি, আপনাদের অফিস দুর্নীতিমুক্ত, আপনি নিজে দুর্নীতিমুক্ত কি না, আগে নিজের কাছে প্রশ্ন করুন। যদি আপনার অফিস দুর্নীতিমুক্ত না হয়, আগে সেটা করুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে আপনাদের অধীনে যেসব অফিস আছে সেগুলোও দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা করুন। নিজের ঘর দুর্নীতিমুক্ত করুন, তারপর অন্যান্য দুর্নীতির খোঁজখবর রাখুন—এই হলো বার্তা।’