আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য চাই সর্বাধুনিক মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি। মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স মডেলের এসব জিপ গাড়ির এক একটির বাজারমূল্য ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। একটি-দুটি নয়, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য এমন উচ্চমূল্যের ৪৬১টি গাড়ি কিনতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর। এ জন্য নিয়মিত বরাদ্দের অতিরিক্ত ৬১২ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসনের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো যানবাহন অধিদপ্তরের চাহিদাপত্র অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকদের জন্য গাড়ি কেনা হবে ৯৬টি। এতে মোট খরচ হবে ১৪০ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য কেনা হবে ৩৬৫ গাড়ি। এগুলোর মোট মূল্য ৫৩২ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ৪৬১ গাড়ি কেনায় সরকারকে ব্যয় করতে হবে মোট ৬৭২ কোটি ৩৪ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মাধ্যমে এসব গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগেই ডিসি-ইউএনওদের কাছে নতুন গাড়ি হস্তান্তর করতে চায় অধিদপ্তর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে যানবাহন অধিদপ্তরের জন্য মোটরযান কেনা বাবদ ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন গাড়ি কিনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত ৬১২ কোটি ৩৪ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চাহিদাপত্রে বিপুলসংখ্যক গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ মাঠপর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সেবা নিশ্চিত করতে এসব গাড়ির প্রয়োজন হবে।’
এমন এক সময়ে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর থেকে ডিসি-ইউএনওদের জন্য বড় লটে বিলাসবহুল গাড়ি চাওয়া হলো, যখন বৈশ্বিক অস্থিরতায় দেশেও অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে সরকার নিজেই চলছে ধার-কর্জের মাধ্যমে। ব্যয় কমাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেট কার্যকরের দ্বিতীয় দিনেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের অর্থ ব্যবহারে কিছুক্ষেত্রে বিধিনিষধ এবং কিছুক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এর আওতায় সরকারিভাবে সব ধরনের গাড়ি, বিমান ও জাহাজ কেনাকাটা বন্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভূমি খাতের অধিগ্রহণ বাবদ বরাদ্দ অর্থসহ আবাসিক, অনাবাসিক, অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচ না করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ, কর্মশালা, সেমিনারে অংশগ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে উল্টো পথে হাঁটছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর। কৃচ্ছ্রতার পরিবর্তে উল্টো গাড়ি বিলাসে নেমেছে এ প্রতিষ্ঠান। যদিও গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা হলেও কৃচ্ছ্র-সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্রের ১০ বছরের বেশি পুরোনো মোটরযান প্রতিস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ওই মোটরযান প্রতিস্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যয় করা যাবে। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর এখন এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে চাইছে।
জানতে চাইলে অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা নিয়মের বাইরে কিছু করিনি। সাধারণত সরকারি যে কোনো গাড়ির বয়স ধরা হয় ৮ বছর। বর্তমানে তা ১০ বছর হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের (জেলা-উপজেলা) জন্য যে ৪৬১টি গাড়ি ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সবকটি গাড়ির আয়ুষ্কালই ইতোমধ্যে ১৩ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স পার হয়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব গাড়ির অনেকই এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পুরোনো হওয়ার কারণে এগুলো মেরামতে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। দিন যত যাবে, এগুলোর সক্রিয় রাখার ব্যয় আরও বাড়বে। মূলত সেগুলোই রিপ্লেস করতে বলা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় অনেক পর্যালোচনার পর যে পরিমাণ গাড়ি রিপ্লেস করা দরকার ছিল, আপাতত প্রস্তাবে তার সর্বনিম্ন চাহিদাই দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গাড়ি ক্রয়ে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নেই সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর বরং সংস্থাটির গাড়ি ক্রয় ও ব্যয়ের ফর্দ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডিসি-ইউএনওদের ৪৬১টি গাড়িসহ চলতি অর্থবছরে মোট ৮৪০টি বিলাসবহুল গাড়ি ও ১৩২টি স্পিডবোট কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৭২ গাড়ি ও স্পিডবোট কেনায় এই অর্থবছরে অধিদপ্তরের মোট প্রয়োজন হবে ১ হাজার ১৬২ কোটি ২৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বছরজুড়ে গাড়ি কেনার পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হবে।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যানবাহন কেনার এ প্রচেষ্টাকে ‘অতি হাস্যকর’ ও ‘অতিবিলাসিতা’ আখ্যা দিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এ ধরনের উদ্যোগ শুধু প্রস্তাব আর পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, অন্তত চলতি অর্থবছর তার কোনোটিরই অনুমোদন মিলবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়েরও এ ধরনের বিলাসী ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া উচিত হবে না।’
বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সব কিছু বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এখন তো সবার আগে দরকার সর্বত্র চরমভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের চর্চা করা; কিন্তু আমরা দেখছি গাড়ি বিলাসের বাহার। এ ধরনের প্রস্তাবকে প্রশ্রয় দেওয়া হলে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা হবে সাধারণের সঙ্গে সরকারের তামাশার শামিল।’
বছরজুড়ে গাড়ি কেনার ছক
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের গাড়ি ক্রয়ের পরিকল্পনা ও ব্যয়ের বিবরণী প্রতিবেদন থেকে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর ভিভিআইপি ও বিদেশি ডেলিগেটদের ব্যবহারের জন্য কেনা হবে নতুন ২০টি মার্সিডিস বেঞ্জ কার (এস ক্লাস-স্যালুন-ডব্লিউভি ২২৩) গাড়ি। অত্যাধুনিক এসব গাড়ির প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে ২০টি মার্সিডিস বেঞ্জ কার ক্রয়ে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জন্য কেনা হবে ৫০টি টয়োটা ক্যাম্রি হাইব্রিড সেডান কার। নাভানা লিমিটেড থেকে এ গাড়ি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গত ৩০ জুন, ২০২৩ সময়ের বাজারমূল্য অনুযায়ী এসব গাড়ির প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জন্য গাড়ি কেনায় মোট খরচ হবে ৫২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের ব্যবহারেও দেওয়া হবে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের ৩০টি মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স জিপ। এসব গাড়ি কেনায় মোট খরচ হবে ৪৩ কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এগুলোও কেনা হবে প্রগতি থেকে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের ব্যবহারের জন্য আরও ২৩৬ জিপ কেনা হবে। এই প্যাকেজের সবকটি গাড়ি কেনায় খরচ হবে ৩৪৪ কোটি ১৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এর বাইরে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হবে ৪৪টি টয়োটা হাইয়েস মাইক্রোবাস। প্রতিটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় সবকটি গাড়ি কিনতে ব্যয় হবে ২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। প্রশাসনিক ডিউটি ও প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য ১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কেনা হবে আরও ৩০টি গাড়ি। এতে প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে ৬১ লাখ টাকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য বছরজুড়ে গাড়ি কেনার রূপরেখায় ৩৬৮টি গাড়ি। এতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫৩৬ কোটি ৭০ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য কেনা হবে ২৬টি টয়োটা হাইয়েস মাইক্রোবাস। নাভানা ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের গত ৩০ জুন নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী এসব গাড়ির প্রতিটির দাম ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা হিসাবে প্রস্তাবিত সবকটি গাড়ি কেনায় মোট খরচ হবে ১৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে জেলা-উপজেলা প্রশাসনে ব্যবহারের জন্য জাপানের দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট ইয়ামাহা কেবিন ক্রুজারও কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ৩৬টি। গোল্ডেন ফাইবার প্লাস থেকে এসব গাড়ি কেনা হবে। প্রতিষ্ঠানটির গত ৩০ জুনের বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রতিটি ৫৫ লাখ টাকা দরে এসব গাড়ি কিনতে মোট ব্যয় হবে ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা প্রশাসনে ব্যবহারের জন্য জাপানের এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট ওপেন টাইপ স্পিডবোট কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ১৩২টি। গোল্ডেন ফাইবার প্লাস থেকে কেনা হবে এসব স্পিডবোট। প্রতিটির (৩০ জুন, ২০২৩) মূল্য ৩০ লাখ টাকা দরে প্যাকেজের সবকটি স্পিডবোট কেনায় খরচ হবে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের ৪৬১ বিলাসবহুল গাড়ি কেনার প্রস্তাব সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কালবেলাকে জানান, সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম সচল রাখতে পরিবহন পুল সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর) থেকে গাড়ি ক্রয় বা রিপ্লেস করার প্রস্তাব নিয়মিত কাজের অংশ। সেটি সময় সময় অনুমোদন দেওয়া হয়। এবারও তারা নিয়মের মধ্য থেকে প্রয়োজনের তাগিদেই গাড়ি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। এখন প্রস্তাটির অনুমোদন দেওয়া হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও মাস দেড় অপেক্ষা করতে হবে।
তারা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে ১০ বছরের পুরোনো গাড়ি প্রতিস্থাপনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সে হিসাবে প্রস্তাবটি অনুমোদনযোগ্য; কিন্তু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনার সময়ে এক সঙ্গে ৪৬১ গাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য বিব্রতকর। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করেই করণীয় ঠিক করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মন্তব্য করুন