..
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে নাম-যশ রয়েছে টিপু কিবরিয়ার। বাজারে জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি ছড়ার বই ছাড়াও ‘হরর ক্লাব’ নামে শিশুদের জন্য সিরিজ বই রয়েছে তার নামে। এসব বই বেশ জনপ্রিয়ও। পাশাপাশি আলোকচিত্রী হিসেবেও তার একটা পরিচয় রয়েছে। এত সুন্দর পরিচয়ের আড়ালে তার আরেকটা কুৎসিত রূপ রয়েছে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি ভয়ংকর এই অপরাধে তালিকাভুক্ত।
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত
বিভাগ-সিআইডি ২০১৪ সালের জুনে টিপু কিবরিয়াকে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের অপরাধে গ্রেপ্তার করেছিল। তখন ওই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়। তবে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ওই মামলার রায়ে তিনি খালাস পান। প্রায় ৬ বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে কারাগার থেকে বের হন। এরপর সবাই ভেবেছিলেন, ‘টিপু কিবরিয়া ভালো হয়ে গেছেন, তার ভুল বুঝতে পেরেছেন।’ তবে তিনি যে ভালো হননি, এবার তা ধরা পড়েছে অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল পুলিশের নজরে।
এরই মধ্যে সেখান থেকে টিপু কিবরিয়ার শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠির সূত্র ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এই শিশুসাহিত্যিককে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আহমেদুল ইসলাম কালবেলাকে জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিপু কিবরিয়াকে তারা গ্রেপ্তার করেছেন। তিনি শিশুসাহিত্যিক হয়ে শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের মতো ভয়ংকর কাজ করে আসছিলেন। মূলত টিপু শিশু পর্নোগ্রাফির আন্তর্জাতিক চক্রের একজন সদস্য।
এই কর্মকর্তা জানান, প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী গ্রেপ্তার টিপু কিবরিয়া ফের শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছিলেন। এসব পর্নোগ্রাফি অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কাছে পাচার করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
টার্গেট ছেলে পথশিশুরা: সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টিপু কিবরিয়ার টার্গেট ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে শিশু। এই ছেলে শিশুদের নিজের হেফাজতে নিতে রাজধানীজুড়ে তার একটা চক্র রয়েছে। চক্রের সদস্যরা ভাসমান মাদকাসক্ত টোকাই শ্রেণির। তাদের প্রথমে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা ও কমদামি মোবাইল ফোন, সিম দিতেন তিনি। এই চক্রে রয়েছে কামরুল ও দেলোয়ার নামে দুজন। তাদের মধ্যে দেলোয়ার হকার। এরা পথশিশুদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে টিপুর কাছে। শিশু সংগ্রহ করতে পারলে তারা ১ থেকে ২ হাজার করে টাকা পায়। ছিন্নমূলের এসব শিশুদের ভালো খাবার ও টাকা দেওয়ার কথা বলে তার কাছে রাখা হয়। পরে তাদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করেন টিপু কিবরিয়া।
বাসার ভেতর গড়েছেন ল্যাব ও স্টুডিও: গ্রেপ্তার অভিযানে থাকা সিটিটিসি সূত্র জানায়, টিপু খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় স্টুডিও তৈরি করেছেন। এখানেও শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফির শুটিং করতেন তিনি। সেখানে ঢুকলে বোঝা যাবে না যে, ভয়ংকর অপরাধ হচ্ছে। অভিযানের সময়েও তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন।
এক কর্মকর্তা জানান, টিপুর কাছ থেকে বেশকিছু ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। এসব ডিভাইসে শিশুদের আপত্তিকর হাজার হাজার স্থিরচিত্র ও ভিডিও রয়েছে। এখন পর্যন্ত তা যাচাই করা হয়েছে, এর সবই অতিবিকৃত।
বিদেশে পাঠানো হতো বিশেষ অ্যাপে: সিটিটিসি কর্মকর্তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৫৮ বছর বয়সী টিপু জানিয়েছেন, তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরি করে ‘মেঘা’ নামের বিশেষ অ্যাপে সেই ভিডিও আন্তর্জাতিক চক্রের কাছে পাঠাতেন। তারাই তাকে এসব ভিডিও তৈরি করতে নানা ধরনের নির্দেশনা দিতেন। সেই নির্দেশনা মেনে তিনি মেঘা ছাড়াও ‘টোটা নোটা’ অ্যাপসে তা পাঠাতেন এবং যোগাযোগ করতেন।
তিনি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, এবার নতুন করে এই অপকর্ম শুরু করে ইতালির এক ব্যক্তি ও অস্ট্রেলিয়ায় এক ব্যক্তির কাছে পর্নোগ্রাফি পাঠিয়েছেন। ১০ থেকে ১২টি পর্নোগ্রাফি পাঠালে তিনি এক হাজার ডলার পেতেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে তিনি টাকা সংগ্রহ করেন।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, টিপু তাদের জানিয়েছেন, শিশুসাহিত্য লেখার সময় তিনি অনেক শিশুর সঙ্গে মিশেছেন। ২০০৫ সালের দিকে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ২০২০ সালে কারাগার থেকে বের হন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হওয়ার পর তার আর লেখালেখি আসছিল না। এরপর ফের টাকার লোভে আগের অপকর্ম শুরু করেন।
অবশ্য ওই কর্মকর্তা বলেন, টিপু সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান। তার সন্তানদের একজন চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়নরত। নিজেদের বাড়ি রয়েছে রাজধানীতে। কিন্তু বিকৃত মানসিকতা ও ডলারের লোভে এই অপকর্ম করে আসছিলেন। মূলত এ ধরনের ভয়ংকর অপরাধ করা তার মগজে ঢুকে গেছে। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে তিনি অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। কিশোর কবিতা, গল্প ও ছড়া ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে তিনি ‘হরর ক্লাব’ নামে কিশোরদের জন্য সিরিজ গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেবা প্রকাশনী থেকে তার এসব লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো।
এর আগে ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে, টিপু টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আট আন্তর্জাতিক পর্নো কারবারির কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।
ওই সময় ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সিআইডি জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্নো ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত টিপু কিবরিয়া। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগটির বিষয়ে নজরদারি করে টিপুর চেহারা শনাক্ত করে ইন্টারপোল। ওই সময় টিপুর বাসায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক পর্নো সিডি, লুব্রিকেটিং জেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টিপু কিবরিয়া ছাড়াও তার আরেক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া তার বাসা থেকে এক শিশু ভুক্তভোগীকে উদ্ধারসহ পর্নোগ্রাফির অসংখ্য কনটেন্ট ও পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।