আগে শীতকাল এলেই দেশে গ্যাসের সংকট হতো। কিন্তু এখন শীতে নয়, বরং প্রচণ্ড গরমে সারা দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে বাসাবাড়িতে জ্বলছে না চুলা। খাবার তৈরি করতে গ্যাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর যে গ্যাস পাওয়া যায়, তা দিয়ে মিটমিট করে জ্বলে চুলা, রান্না করতে কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। দিনের বেলায় রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের দেখা মেলে না। আর গভীর রাতে গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া গেলেও চাপ থাকে খুবই কম। এ অবস্থায় গ্যাসের অভাবে রান্না করতে না পারায় হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পারিবারিক খরচ বেড়ে গেছে। হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
শুধু বাসাবাড়ি নয়, গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদনেও ধস নেমেছে। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমেছে, হচ্ছে লোডশেডিং। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে থাকা একটি এলএনজি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণে থাকায় বর্তমানে আগের চেয়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ হচ্ছে। এর প্রভাবে সারা দেশে গ্যাসের সংকট চলছে। জ্বালানি সচিব নূরুল আলম কালবেলাকে বলেন, দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। আশা করছি, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে টার্মিনালটি দেশে এসে অপারেশন শুরু করবে। তখন বর্তমান সংকট অনেকখানি কেটে যাবে।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এলএনজি আমদানি কম এবং দেশীয় কয়েকটি গ্যাসকূপের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। এখন দেশে চাহিদার বিপরীতে ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে ২৪ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সামিটের এলএনজি টার্মিনাল নষ্ট হলে চার কার্গো এলএনজির ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়।
রাজধানীর গ্রিন রোডের ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ট্রিটের বাসিন্দা ইউনূছ গনি এই প্রতিবেদককে জানান, ভোর থেকেই গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। গ্যাস পাওয়া যায় রাত ১২টার পর। এই অবস্থা ১৫ দিন ধরে চলছে। তিনি জানান, গ্যাস না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে পরিবারের শিশুদের খাবার তৈরি করতে। অনেক সময় বাইরে থেকে অনিরাপদ খাবার কিনে খাওয়াতে হচ্ছে। এতে হিসাবের সংসারে খরচও বাড়ছে। পুরান ঢাকার লালবাগের রাজা শ্রীনাম স্ট্রিটের বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, দিনের বেলায় গ্যাসের দেখা পাওয়া যায় না। মধ্যরাতে গ্যাস এলেও চাপ খুবই কম থাকে। রান্না করার জন্য রাত জেগে থাকতে হয়।
রাজধানীর রামপুরা, মগবাজার এলাকার বাসিন্দারা রয়েছেন সরচেয়ে খারাপ অবস্থায়। দিনরাত মিলিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা গ্যাস পাওয়া গেলেও রান্নার কাজ করা যায় না। কারণ চাপ থাকে অনেক কম। মগবাজার ডাক্তারের গলির বাসিন্দা সৌমিত্র ভদ্র জানান, কখন গ্যাস আসে আর যায়, বলতে পারি না। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে চুলা মিটমিট করে জ্বলে। কিন্তু রান্না করার মতো চাপ থাকে না। আড়াইশ গ্রাম চালের ভাত রান্না করতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়।
শিল্পের উৎপাদন কমেছে:
তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদনেও ধস নেমেছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। একাধিক গার্মেন্টস মালিক জানান, গ্যাসের অভাবে উৎপাদন করতে না পারায় রপ্তানি আদেশ বাতিল হচ্ছে। পণ্য না পেয়ে বিদেশি বায়াররা চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। তারা জানান, একটি কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ দরকার। বর্তমানে তা এক থেকে দুই পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের ডিজেলচালিত জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, মদনগঞ্জ, চন্দ্রাসহ সব শিল্পাঞ্চলের একই চিত্র।
এ অবস্থায় গত ৪ জুন পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণের অনুরোধ জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারকে চিঠি দেয় বিটিএমএ।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালবেলাকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমনিতেই রপ্তানি আদেশ কম, এর পরও যে রপ্তানি আদেশ আছে সেটাও আমরা সময়মতো করতে পারছি না। আমরা এখন আমেরিকার মার্কেটে ১৯ পার্সেন্ট মাইনাস পজিশনে রয়েছি, যেখানে ভিয়েতনাম ও চীন পজিটিভ গ্রোথ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কম, হচ্ছে লোডশেডিং:
গ্যাস সংকটে গ্যাসভিত্তিক বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিদ্যুতের বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে দেশব্যাপী হঠাৎ করে তিন দিন ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। গ্রামাঞ্চলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বিকেল ৫টায় এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে।
গ্যাস সংকটের কারণে কমবেশি ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল এ খাতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় ৯৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল গ্যাস সংকটে দুই হাজার ৯৪৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল।
রাজধানীসহ সারা দেশের সিএনজি স্টেশনেও সারাদিন দীর্ঘ লাইন থাকছে। কারণ গ্যাসের প্রেসার নেই। গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় দেশের ৫৯০টি সিএনজি স্টেশনের মধ্যে ৬৬টি বন্ধ হয়ে গেছে।
সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নুর জানান, বারবার পেট্রোবাংলাকে গ্যাসের চাপ নিয়ে বললেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই খাতে ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা। অনেকেই লোকসান দিয়ে স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছেন।