মাওলানা একরামুল হক
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ হত্যা মহাপাপ

মানুষ হত্যা মহাপাপ

মানুষ মহান আল্লাহর অত্যন্ত মহব্বতের সৃষ্টি। মহান আল্লাহ নিজ কুদরতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর এজন্যই তিনি মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষকে এই জমিনে তার প্রতিনিধি বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘স্মরণ করুন ওই সময়ের কথা, যখন আপনার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন তারা বলল, আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই প্রতিনিয়ত আপনার গুণকীর্তন করছি এবং আপনার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।’ (সুরা বাকারা: ৩০)। এই মহব্বত আর ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন তার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ (সুরা ত্বিন: ৪)। শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, এই বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন শুধু মানুষেরই জন্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সব কিছু।’ (সুরা বাকারা: ২৯)।

আল্লাহ যেমন মায়া-মহব্বত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তেমন মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষ জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে, কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনে তো আল্লাহ একজন মানুষ হত্যা করাকে গোটা মানব জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)। অন্যদিকে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকেও গোটা মানব জাতির জীবন রক্ষা বলে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)।

আর এসব কারণেই মানুষকে হত্যা শিরকের পর সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ। মানব হত্যাকারী ব্যক্তি আল্লাহর বিচারে খুনি। রাষ্ট্রের বিচারে খুনি। নিজের বিবেকের বিচারেও খুনি। নিজের ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান্ধব, আপনজন, আত্মীয়স্বজনের দৃষ্টিতেও খুনি। খুনি হিসেবে সবার অভিশাপ তাকে তাড়া করে। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে, সে খুনি হিসেবে বেঁচে আছে? তারপর জীবন শেষ বিচারে চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছা করে হত্যা করল, তার প্রতিফল হলো জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল বসবাস করবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে থাকেন, তাকে অভিসম্পাত করেন; আর তার জন্য ভয়ানক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ৯৩)

অথচ মানুষ সামান্য স্বার্থের কারণে, কখনো রাজনৈতিক কারণে নিষ্পাপ শিশুকে পর্যন্ত হত্যা করে ফেলছে। এ কী নিষ্ঠুরতা! অথচ যে কোনো ধর্মের মানুষ হোক বিনা কারণে রক্তপাত করা ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য অপরাধ। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যার অপরাধ বা দেশে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করার অপরাধ ব্যতীত কোনো মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা: ৩২)। তাই খুনি সে যেই হোক, যে ধর্মের হোক, আর যে চেতনার হোক, যে কারণেই হোক, সবসময় সে মানব সমাজের জন্য, সভ্যতার জন্য হুমকি। মহান আল্লাহর এই বাণী এ কথার প্রমাণ।

মানুষের জীবনটা তার স্রষ্টার কাছে অনেক মূল্যবান। হাদিসে এসেছে ‘উপযুক্ত কারণ ব্যতীত কোনো মুমিনকে খুন করা যে অপরাধ, তার চেয়ে পুরো দুনিয়া ধ্বংস করা আল্লাহ কাছে লঘুতর পাপ।’ (ইবনে মাজা, কিতাবুদ দিয়াত)

অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা কেয়ামতের অন্যতম আলামত। হাদিসে এসেছে ‘যে সত্তার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই মানব সমাজে এমন সময় আসবে, খুনি জানবে না, সে কেন খুন করেছে, আর নিহত ব্যক্তি বুঝবে না, কীসের জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান)

হজরত ইবনে আব্বাসকে (রা.) প্রশ্ন করা হলো, এক ব্যক্তি একজন মুমিনকে হত্যা করেছে। এরপর তওবা করেছে, ইমানদার হয়ে গেছে, নেক আমল করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে। তিনি বললেন ‘তোমাকে ধিক্কার! সে হেদায়েত পায় কীভাবে? আমি তোমাদের নবী (সা.)-র মুখে শুনেছি নিহত ব্যক্তি তার খুনিকে টেনেহিঁচড়ে আল্লাহর কাছে নিয়ে আসবে। আর বলবে হে রব, আপনি জিজ্ঞেস করুন, সে কেন আমাকে খুন করেছে? আল্লাহর কসম! আল্লাহ এ ব্যাপারে তোমাদের নবীর ওপর যা নাজিল করেছেন (সুরা নিসার ৯৩ আয়াত) তা রহিত করেননি।’ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, খুনির তওবা আল্লাহ কবুল করবেন না। যদিও অধিকাংশ আলেমের মত হলো, এটি মূলত ধমকি হিসেবে বলা হয়েছে। অতএব, দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য যারা কথায় কথায় মানুষ হত্যা করে, তাদের ভাবা উচিত কী পরিণাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

যেহেতু একজন মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি, তাই এর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন কঠোর আইন ও বিধান। আর তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য কিসাসের মতো কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন। কিসাস হচ্ছে কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এর শাস্তিস্বরূপ ঘাতককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা: ১৭৮)। আবার এই কিসাসের মধ্যে আল্লাহ মানব জাতির জীবন নিহিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।’ (সুরা বাকারা: ১৭৯)। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্যায়ভাবে যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করে, তখন সে এতটাই অপাঙক্তেয় হয়ে যায় যে, সে পৃথিবীতে থাকার, মনুষ্য সমাজে বাস করার অধিকার হারায়। সে হয়ে পড়ে মানব সমাজের এক মরণঘাতী ব্যাধি, মানব সমাজে টিকে থাকার জন্য যার অপসারণ অপরিহার্য। আর অপসারণের কাজটিই হয় কিসাস তথা ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে। ফলে, এ কথা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, কোনো ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর মানেই অন্যান্য মানুষের নিরাপদ জীবন লাভ।

মানব জাতির মধ্যে যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে অর্থাৎ যারা ইমানদার মুসলমান, তাদের বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে তো কোরআনে রয়েছে আরও কঠিন ধমকি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : ৯৩)। এ আয়াত এ কথাই প্রমাণ করে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা বিচারে কোনো ইমানদারকে হত্যা করলে তার শাস্তি হবে চিরকালীন জাহান্নাম এবং সে আল্লাহর গজব ও অভিশাপের শিকার হবে আর তার জন্য রয়েছে কঠোর আজাব। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করাকে কুফরি বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং তাকে হত্যা করা কুফরি।’ (বুখারি, মুসলিম)। এ হাদিসদ্বয় দ্বারা বোঝা যায়, কোনো ব্যক্তি তার মধ্যে ইমান থাকা অবস্থায় অন্য মোমিন মুসলমান ভাইকে হত্যা করতে পারে না। কারণ মুসলমান তো কেবল সেই হতে পারে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। যেমন এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘খাঁটি মুসলমান হচ্ছে সে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’

সার কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা হচ্ছে একটি জঘন্যতম অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির বদলায় ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, তা ছাড়া ঘাতকের জন্য আল্লাহর রোষানলে পড়ে ধ্বংস হওয়া এবং তার লানতের শিকার হওয়ার মতো কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। এ ছাড়া আখেরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের গোটা জাতিকে এই ভয়ংকর অপকর্ম থেকে হেফাজত করুন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৯ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধ দিয়ে গোসল 

সেনাবাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক 

ইবি ছাত্রের রহস্যজন্যক মৃত্যুর তদন্তের দাবিতে ছাত্রশিবিরের টর্চ মিছিল

বাঙলা কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ সাগরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কেশবপুরে ৩১ দফার প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু

মাদ্রাসা টিকে আছে বলেই আমাদের ওপর বিভিন্ন ঝড় ঝাপটা আসে : ধর্ম উপদেষ্টা 

ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার

১০

রাজবাড়ী জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ বাঙলা কলেজ শাখার কমিটি গঠন

১১

গণঅভ্যুত্থান মেহনতি মানুষের কষ্ট লাঘব করেনি : সাইফুল হক 

১২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক পোস্ট

১৩

মাদকাসক্ত যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল মা ও ভাই

১৪

এবার পুলিশের সামনেই চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল 

১৫

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন চাষে বিপাকে কৃষক

১৬

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় কারা সুযোগ পাবে, বাছাই হবে যেভাবে

১৭

হাসপাতালের লিফটের নিচে পড়ে ছিল রোগীর অর্ধগলিত লাশ

১৮

পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রেতা, অতঃপর…

১৯

নির্বাচন পেছাতে ‘সংস্কার-বিচারের’ নামে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে : আমিনুল হক

২০
X