কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ঝড় থামলেও, মেঘ কাটেনি। দেশের রাজনীতির আকাশে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে খণ্ড খণ্ড ধূসর কালো মেঘ। সাম্প্রতিক ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, বিনষ্ট হয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা। ফলে জনমনে এখনো বিরাজ করছে নানামুখী শঙ্কা ও ভয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক উদ্যোগ, অর্থাৎ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিলেও, তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এক ধরনের জটিল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সহায়তা নিতে হয় সর্বোচ্চ আদালতের। সহিংসতা প্রতিরোধে মোতায়েন করতে হয় সেনাবাহিনী, জারি করতে হয় কারফিউ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হল ছেড়ে যান শিক্ষার্থীরা, বন্ধ করতে হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—‘বন্যরা বনে সুন্দর, আওয়ামী লীগ রাজপথে’। অর্থাৎ রাজপথের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের জুরি মেলা ভার। জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই রাজপথে ছিল এবং অদ্যাবধি রয়েছে। আওয়ামী লীগের অগণিত নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীকে রাজপথের আন্দোলনে কখনো বিপর্যস্ত হতে দেখা যায়নি। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক কৌশলের দুর্বলতা—উভয়ই আলোচনায় এসেছে এবং নতুন করে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে গণমানুষের হৃদয়ে দ্রুতই জায়গা করে নেয় দলটি। যার প্রতিফলন ঘটে ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্য দিয়ে, যা বাঙালি জাতিকে নিয়ে যায় স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যও ছিল এক মহাবিপর্যয়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বদানে যারা সক্ষম ছিলেন, তারা হলেন তারই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় একই খুনিচক্র তাদেরও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে। এমন মহাবিপর্যয়ের পর আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়ায়। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে ফের গতি পায় ১৯৮১ সালে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে। ২০০৮ সালে এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে আবারও সংকটে পড়ে দলটি। তবে সব বাধা পেরিয়ে ২০০৯-এ ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর দল।
স্বাধীনতার পতাকাবাহী আওয়ামী লীগের দীর্ঘ পথচলায় যেমন অনেক অর্জন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু ব্যর্থতাও। এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে জনমানুষের অন্তরে ঠাঁই পেতে যেভাবে কাজ করছে, তেমনি বর্তমান সংকটও তারা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করবে। পাল্টে যাওয়া সময় এবং পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের আরও সংগঠিত করবে। সেইসঙ্গে এগিয়ে নেবে দেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।