মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:১৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধর্ম অবমাননা বর্জনীয়

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধর্ম অবমাননা বর্জনীয়

সৃষ্টিকর্তা কেমন, কী তার রূপ, কেমন তার শক্তি এবং মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, এ নিয়ে নানা দর্শন, নানা মতভেদ। এ মতভেদের জন্য একে অন্যের ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে কোথাও কোথাও সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিশ্বসমাজকে রক্তাক্ত করেছে ও করছে। এর থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব গুণগানে অন্য ধর্মকে খাটো করার প্রবণতা ধ্বংসাত্মক। এটা উগ্রভাবে জাঁকিয়ে বসছে। এমন কর্মকাণ্ডে উপকার হয় না। হানাহানি বাড়ে এবং সেসব ভূমিকা অনিবার্য যন্ত্রণা ডেকে আনে। মানুষে মানুষে শুধুই তৈরি হয় বিপুল দূরত্ব। অথচ এই আধুনিক সময়ে দরকার মানুষের সঙ্গে মানুষের নিবিড় যোগাযোগ। প্রয়োজন মানবিক বন্ধন। কিন্তু এমন দর্শনের বিপরীতে বিশ্বের নানা প্রান্তে দেখা যাচ্ছে অসহিষ্ণুতা।

এই যে ঈশ্বরের ধারণা, তা একটি বিশ্বাস ও ধারণা। ঈশ্বর ধারণার ওপর অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ। যারা ধর্মের মধ্যে এ দর্শনটি বুঝতে চান, তারা সে অনুযায়ী পাঠ করুন। তবে ঈশ্বরের অধ্যয়ন কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং প্রেমময় অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস হিসেবে হলে উদারতার একটি জায়গা তৈরি হয়, যা কি না পরস্পর ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বকেন্দ্রিক একতরফা উগ্র চিন্তাকে প্রশমিত করতে সহায়তা দেয়। এমন পাঠ ঈশ্বরের ধারণার পক্ষে এবং বিপক্ষে ইতিহাস জুড়ে চিহ্নিত যুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে। এর একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যুক্তিযুক্ত ভাষার বিপরীতে যৌক্তিকতার পরতগুলো নিরীক্ষা করা। এগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং অর্থনীতির বিকাশ ধারার সম্পর্ক নির্মিত হলে ঈশ্বর ধারণার বিষয়ে অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে মানুষ সহায়তা লাভ করে। কিন্তু এসব কিছুই বড়মাপে অনুপস্থিত। ফলে আজকাল প্রায়ই দেখা যাচ্ছে কোরআন অবমাননা করতে। বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে ইউরোপের মাটিতে কোরআন পুড়িয়ে দেওয়া। সম্প্রতি সুইডেনে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবমাননার ঘটনা ঘটল। এত করে বিশ্ব উত্তপ্ত হয়েছে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১ জুলাই শুক্রবার, সুইডেনের ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী ড্যানস্কে প্যাট্রিয়টার কোপেনহেগেন ইরাকি দূতাবাসের সামনে এ কোরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটায়। গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, তারা এ কাজটি করেছে মূলত ইরাকে সুইডিশ দূতাবাসে হামলার প্রতিবাদে।

এর পরপরই তোরাহ ও বাইবেল পোড়ানোর অনুমতি চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করেছে একজন। তার আবেদনে সে বলেছে, কোরআন অবমাননার প্রতিবাদে তোরাহ ও বাইবেল পোড়ানো হবে। বিষয়টি আবেদনকারীরা তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। দেশটির পুলিশ সে আবেদনে সাড়া দিয়ে অনুমতি দেয়। সুতরাং পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিবাদে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তোরাহ (তাওরাত) ও বাইবেল পোড়ানোর অনুমতি লাভ করে প্রতিবাদকারীরা। তবে স্টকহোম পুলিশ বলেছে, তারা শুধু সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পোড়ানোর জন্য নয়। এতে করে সারা বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়। পুলিশের এমন সিদ্ধান্তে ইসরায়েলসহ বিভিন্ন ইহুদি সংগঠন নিন্দা জানানোর পাশাপাশি তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করে। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ তীব্র প্রতিবাদ করেন। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ বলেছেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে সুইডেনে পবিত্র গ্রন্থ পোড়ানোর অনুমতি দেওয়ার নিন্দা জানাই।’

অবশেষে ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তোরাহ ও খ্রিষ্টান ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল পোড়ানোর অনুমতি পাওয়া আহমাদ আলুশ (৩২) নামে এক ব্যক্তি এ পথ পরিহার করেন। ওই কাণ্ড ঘটানোর পরিবর্তে কোরআন হাতে তিনি ইসরায়েলের দূতাবাসের সামনে গিয়ে হাজির হন। জনসম্মুখে আলুশ বলেন, আমি কখনোই কোনো ধর্মগ্রন্থ পোড়াব না। ইসলাম আমাকে এ শিক্ষা দেয় না। আর সত্যি বলতে, তোরাহ ও বাইবেল পোড়ানোর কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। আমি শুধু আমার ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন পোড়ানোর প্রতিবাদস্বরূপ এ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলাম।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ডেনমার্কে আবারও কোরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটল। দেশটির ইরাকি দূতাবাসের সামনে এ কোরআন পোড়ায় একজন। পাশাপাশি ইরাকের পতাকাও পুড়িয়েছে।

এই যে এমন করে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, এসব কিছু বিশ্বসমাজ কাঠামোয় সংঘাত উসকে দিচ্ছে প্রবলভাবে। এর থেকে পরিত্রাণ জরুরি। দরকার আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং পর্যাপ্ত সম্পর্কের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিঘ্ন ও বৈষম্যের এ যুগে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা বহুগুণ বেড়েছে। আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান বিশ্বধর্মের জন্য অনিবার্য। এটি দুর্দশাগ্রস্ত মানবজাতিকে আরও গ্রহণযোগ্য পরিবেশে একসঙ্গে বসার কৌশল এবং পদ্ধতিগুলো খুঁজে পেতে সক্ষম করতে পারে।

বিশ্বের ধর্মগুলোর মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির অবস্থা জানতে গবেষণা দরকার। ইসালাম কী বলছে, তাওরাত কী বলছে, বাইবেল কী বলছে—তা জানা প্রয়োজন।

ইসলামে আল্লাহর অস্তিত্ব সুস্পষ্ট করে বর্ণিত, যেখানে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার প্রেরিত পুরুষ। ইসলামে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির দ্বৈত ধারণা ও ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসন্ধান করার অপরিহার্যতা স্পষ্ট। ইসলাম পারস্পরিক শ্রদ্ধার শিক্ষা দেয়। সমগ্র ঐশ্বরিক সৃষ্টি এবং বিশেষত মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবার অনুভূতি ও প্রতিজ্ঞা এবং মৌলিক সত্যের উপলব্ধি রপ্ত করতে ইসলাম আহ্বান করে।

অন্যদিকে তোরাহ বা তাওরাত বলছে, মানব প্রাণী অবশ্যই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার অধীন। মানুষ পৃথিবীতে জগতিক কাজের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চালিয়ে যায়। তাওরাতের আদেশগুলো শুধু মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে পালন হিসেবে পালন করা হয় না, বরং মানুষের নিজেদের মধ্যে এবং মানুষ ও জগতের মধ্যে ক্রিয়া হিসেবে পালন করা হয়।

আমরা সবাই কী চাই? চাই সুখী হতে। সনাতন ধর্মগ্রন্থ গীতাতেও সে কথা, সে বিষয়ে আলোকপাত। গীতার দর্শনে বলা হচ্ছে, সবাই সুখী হতে চায় এবং সবাই প্রতিনিয়ত সেই সুখের সন্ধান করে। গীতায় বলা হচ্ছে সঠিক জ্ঞান জেনে নাও। কীভাবে জীবনের সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়, সর্বাধিক সুখ অর্জন করা যায় তা বুঝতে চেষ্টা করো। সঠিক জ্ঞানের অভাবে মানুষ যদি জীবনের শক্তি ব্যবহারের নিজস্ব উপায়ে উদ্ভাবন করতে না পারে, তবে শেষ পর্যন্ত সে হতাশ হয়ে যায়।

সুতরাং, ভগবদগীতা হলো পরম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রদত্ত ম্যানুয়াল, যা মানবজীবনের শক্তিকে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে এবং এটি থেকে প্রকৃত সুখ অর্জন করতে গাইড করে।

ইসলামের বিধিতে বলা রয়েছে, একজন মুসলমান, যদি সে ইসলামের মৌলিক অর্থ বোঝে, তবে সে কখনোই কোনো ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলতে পারে না। ইসলাম ঐশ্বরিক নির্দেশনা এবং ওহির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। যদি সব ধর্মের সারবত্তাকে কেন্দ্র করে মূল দর্শনের ওপর আলো ফেলা হয়, তবে দেখা যাবে, ধর্মগ্রন্থের বিস্তৃত বিবরণ যাই হোক না কেন, সেগুলোর নির্যাস হলো মানুষকে ভালোবাসা। এর ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে প্রবলভাবে। এখানেই সব সুযোগ নিহিত আন্তঃধর্ম পাঠ এবং আন্তঃধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শান্তির মিলনে বার্তা দেওয়া। এটা করতে পারলে সবাইকে একটি মিলনসূত্রে গাঁথার সুযোগ আসে। এটা করতে পারলে বিশ্বে আন্তঃধর্মীয় শ্রদ্ধা বাড়বে এবং

আর এ দ্বারা আন্তর্জাতিক সহিষ্ণুতা ও সদিচ্ছা-যুগের সূচনা হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাশিল্পী।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘বিএনপিকে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের নেতারা বিশ্বাস করে’

৩৬ হাজারে বিক্রি ২৪ কেজির কোরাল

কিছু বিষয় আলোচনা না হলেও জুলাই সনদে রাখা হয়েছে : সালাহউদ্দিন

খাবারে বিষক্রিয়া, বন্ধ হলো রণবীরের সিনেমার শুটিং

ভিটাসহ শ্বশুরবাড়ি বিক্রি করে দিলেন নাজমুল

ব্রাজিল দলে জায়গা হারাচ্ছেন ভিনি!

সৌন্দর্যের রহস্য ফাঁস করলেন সানি লিওন

কম্পিউটারের জন্য নিখোঁজ, ১০ দিনেও মেলেনি রাকিবের সন্ধান

বুকে ব্যথা, জ্ঞান হারালেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের মনোনয়নপত্র ক্রয় ঠেকাতে মব করা হয়েছে : রিজভী

১০

আশুলিয়ায় হত্যা মামলার আসামি যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১১

ওয়াইফাইয়ের গতি কম? বাড়াবেন যে ১০ উপায়ে

১২

জেনেভা ক্যাম্পের হত্যা মামলায় ২৬ আসামিকে গ্রেপ্তার  

১৩

রিয়ালের চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ভিনি

১৪

মাউশির চেয়ারম্যানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৫

সচিবালয়ের সামনে জুলাই শহীদ পরিবার ও আহতদের অবস্থান

১৬

শিক্ষার্থীদের রাতের আড্ডা বন্ধে চৌদ্দগ্রাম ইউএনওর অভিযান

১৭

কাজে আসছে না কোটি টাকার নৌ অ্যাম্বুলেন্স

১৮

আইপিএলের পর দ্বিতীয় সেরা হতে চায় যে টি-টোয়েন্টি লিগ

১৯

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে সেমিস্টার ডে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন

২০
X