আজ ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি, বিশিষ্ট নেতা, শ্রমিক-কৃষক সংগ্রামের অগ্রপথিক কমরেড মণি সিংহ ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯৯০ সালের আজকের দিনে তার জীবনাবসান হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে মহান এ নেতা শয্যাশায়ী ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। কমরেড মণি সিংহ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তার আদর্শ, সংগ্রামী চেতনা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও আমাদের অন্তরে জীবিত। তিনি শুধু একজন বিপ্লবী নেতা ছিলেন না, ছিলেন এক নিষ্ঠাবান সংগ্রামী, যিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ আমরা ফিরে দেখি তার জীবন ও কর্মকে। তার অবদান স্মরণ করি। মণি সিংহের জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুন এক জমিদার বংশে। সুসং দুর্গাপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য চলে যান কলকাতায়। ১৯১৪ সালে যোগ দেন অনুশীলন দলে। ১৯২৫-এ মার্ক্সবাদের দীক্ষা নিয়ে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কারা নির্যাতন, হুলিয়া ইত্যাদি ভোগের পর ১৯৩৭ সালে চলে আসেন সুসং দুর্গাপুরে। ওই এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করে টং প্রথার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের অপরাধে পাকিস্তান সরকার তার ওপর হুলিয়া জারি করে এবং তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে। একটানা ২০ বছর হুলিয়া মাথায় নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা করেন। ১৯৬৭ সালে আত্মগোপন অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অসামান্য ও অনস্বীকার্য।
মণি সিংহের রাজনৈতিক জীবন ছিল তীব্র সংগ্রামে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম, তথা মানুষের অধিকারের জন্য তার অবদান অমূল্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সমাজে মানুষকে ন্যায্য অধিকার দেওয়া হবে না, সেই সমাজ কখনো উন্নতির দিকে এগোতে পারে না। তার জীবন ছিল একজন সিপাহি, যিনি শুধু কথায় নয়, কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সমাজের শোষিত শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছেন।
কমরেড মণি সিংহের আদর্শ ছিল সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির আদর্শ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের সমাজে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য এক অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা। তাই তিনি প্রতিনিয়ত সেই শোষণ-শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামই করেননি, সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তার মতে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব না ঘটলে কোনো প্রকৃত সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।
মণি সিংহের মৃত্যু তার অনুসারীদের জন্য একটি বিরাট শূন্যতা তৈরি করলেও তার আদর্শ ও সংগ্রামের ঐতিহ্য বর্তমানেও আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। আজকের দিনেও যখন সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য চরমে, তখন তার সংগ্রামী জীবন এবং চিন্তাভাবনা আমাদের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আমরা যদি তার চিন্তাধারা অনুসরণ করি, তবে আমরা বুঝতে পারব যে, সমাজের প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের শক্তি ও ঐক্য দিয়ে শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব।
এখনো অনেক পথ বাকি। যেহেতু কমরেড মণি সিংহের মতো নেতার আদর্শ কখনো মরে না, তাই তার জীবন ও আদর্শ সামনে রেখে আমরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা শুধু তাকে স্মরণ করি না, বরং তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামনের দিনগুলোয় মানুষের জন্য একটি ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার সংগ্রামে অংশগ্রহণের শপথ গ্রহণ করি।
কমরেড মণি সিংহের মৃত্যুবার্ষিকী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে সংগ্রাম তিনি চালিয়ে গেছেন, তা কোনো কালের জন্য থামবে না। তার চেতনা আজও আমাদের পথ দেখায়, আমাদের শক্তি জোগায় এবং আমাদের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে।
লেখক: কবি