মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪ এএম
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চাই সুচিন্তিত পদক্ষেপ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমাদের সমাজে স্বপ্নভঙ্গের এক চাপা কষ্ট বয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের অন্তরে। লক্ষ করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তারা একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছে। অপরাধের মাত্রার সঙ্গে নৃশংসতার ধরনও পাল্টাচ্ছে, যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।

বেশি দূরঅতীত নয় যখন একটি কিশোরকে সিগারেট ফুঁকতে দেখলে, কিশোর-কিশোরীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলে সবাই বিস্মিত হতেন। আজ সেখানে অবলীলাক্রমে মারামারি, কাটাকাটি করতে দেখে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, না দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতে হয় আমাদের। ব্যাপারটা যেন এমনই স্বাভাবিক ও গা-সওয়া হয়ে গেছে।

বেশ কিছুকাল আগে থেকে দেশে কিশোর অপরাধ বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। পাড়া-মহল্লায় এদের সরব উপস্থিতি এলাকার বড়দের নজর কাড়ে। কখনো তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি দিয়ে পাড়ার শান্তি-শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিক অবস্থায় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কিশোর ক্রমে অপরাধী হয়ে ওঠে। এরপর ওরা দলবদ্ধ হয়ে দেশজুড়ে বিস্তার লাভ করে, যা আজ কিশোর গ্যাং নামে পরিচিতি লাভ করেছে এবং কিশোর গ্যাং কালচার আজ এক সামাজিক ও জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে কিশোর গ্যাং নতুনরূপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে দেশের প্রধান শিল্প খাত গার্মেন্টসে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষের একপর্যায়ে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হলেও কিছু পোশাক কারখানায় বেশ কদিন ধরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এবং এতে মুখোশ পরে হাতে লোহার রড, লাঠি নিয়ে কিশোর গ্যাংকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। দেশে বর্তমানে আড়াই শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে এবং এর সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে দেশের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তান রয়েছে। দুই বছর আগে রাজশাহীতে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। দেশে কিশোর গ্যাং দ্বারা সংঘটিত অপরাধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় এক ছাত্র হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা লোকসমক্ষে আসে। এরপর ঢাকার মোহাম্মদপুরসহ দেশের নানা স্থানে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

অপরাধী হয়ে কেউ জন্মায় না। লক্ষ করলে দেখা যায়, অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্তের। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযত্ন, অবহেলার মধ্য দিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে ওরা হয় বঞ্চিত। প্রতিকূল পরিবেশে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে একসময় অপরাধ জগতের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। কখনো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ছাড়াও উচ্চবিত্তের পরিবারের কিশোরদের কখনো ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি অর্থের প্রাচুর্যও কখনো অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের অসতর্কতার কারণে এসব কিশোর অসৎ সঙ্গে মেশার সুযোগ করে নিচ্ছে। নেশার ঘোরে ঘটিয়ে চলছে নানা অপরাধ, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ। এরা মা-বাবা, নিকটাত্মীয়কে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন ও বিপণনের স্বার্থে নিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপে গ্রুপে মারামারি হরহামেশা লেগেই আছে। আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের এ যুগে অশ্লীল ভিডিও, ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার তাদের বিপথগামী করে তুলছে। পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসনের অভাবে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওরা অর্থ ব্যয় করে নেশার পেছনে। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি রয়েছে অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে।

দেশে কিশোর অপরাধ হঠাৎ শুরু হয়নি। বিশ্বে কিশোর গ্যাং অপরাধের শুরুটা হয়েছে আঠারো শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ডে। তবে ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার লাভ করতে থাকে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত মানের পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নামে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এক স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা কিশোরদের লাগানো হচ্ছে। কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজব্যবস্থায়। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদারের নেতৃত্বে এদের অস্ত্র বহনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত থাকার নজির রয়েছে। সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ছিন্নমূল পরিবারের কিশোরদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টেনে আনে। সাহসী ও বুদ্ধিমান কিশোরদের মাদক বিক্রি, অস্ত্র ও বোমা বহনের মতো মারাত্মক কাজে ব্যবহার করা হয়। এসব কিশোর অপরাধীর অনেকেরই বয়স যেহেতু ১৮ বছরের নিচে, তাই আইনানুযায়ী তাদের অপরাধকে শাস্তির আওতায় আনা হলেও তা হচ্ছে লঘু।

পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা, সমাজ বৈষম্য, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, একাকিত্ব, মাদকাসক্তি, অশ্লীল ও সহিংসতানির্ভর ছবি দেখা, আপত্তিকর ভিডিও গেমে আসক্তি, ভিনদেশি কালচারে অভ্যস্ততা এবং হিরোইজম প্রদর্শন কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিক্ষার বাইরে থাকা দেশের বিশাল অংশের কিশোর মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারে ব্যস্ত কাটায় এক পরিবার-বিচ্ছিন্ন জগতে। এ ছাড়া শরীরচর্চা, খেলাধুলার সময় নেই আজকের সর্বস্তরের কিশোর-তরুণদের। কোনো বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও ব্যবস্থা নেই ওদের। কৈশোরের মনোজগতের বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা ধাবিত হয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়। এর অবসান ঘটাতে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবাহ সৃষ্টি করতে সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের যত্নশীল হতে হবে। কিশোর অপরাধ দূরীকরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না করলে কিশোর গ্যাং কালচার স্থায়ী ব্যাধি ক্যান্সার রূপে ছড়িয়ে পড়বে। কিশোরদের রাজনৈতিক মিটিংয়ে, মিছিলে সহিংস কর্মকাণ্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

দেশের কিশোর-সম্প্রদায় একটি সুশীল সভ্যসমাজের ভবিষ্যতের কান্ডারি হয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে যুগে যুগে বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক জাগরণের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে দেশ গড়ার মতো প্রতিটি শুভকাজে কিশোরসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে যে তারুণ্যের বিজয়গাথা আমাদের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছে; আজকের কিশোর দিনে দিনে বেড়ে পরিণত মানুষ হয়ে ওঠে। অনুকূল পরিবেশ পেলে ধীরে ধীরে তাদের মনে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। বিদ্যা-বুদ্ধি-মননে, প্রগতিশীলতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। কিশোর দেহমনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যা, অফুরন্ত আলোকময় পরিবেশ। দেশের অধিকারবঞ্চিত কিশোরদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বস্ত্র ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি কিশোর উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে যোগ্যতা অনুসারে কাজ করার সুযোগ পেলে কখনোই ওরা অপরাধে জড়াবে না। বল বা শাস্তি প্রয়োগ কিশোর অপরাধ দমনের স্থায়ী পথ নয়। নিম্নবিত্তের শিশুদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। কিশোরদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন সুবিধা দিতে হবে। ছিন্নমূল কিশোরদের করতে হবে পুনর্বাসন। অপরাধচক্রে জড়িয়ে যাওয়া কিশোরদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়াতে হবে কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা ও গুণগত মান। শিক্ষার পাশাপাশি ওদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উন্নত চিন্তা-চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিশোর গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতা। ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কিশোরদের ব্যবহার করলে এক দিন এরাই রাজনীতিবিদদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আগামীর উন্নত দেশ গড়ায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কিশোর অপরাধের উত্থান প্রতিরোধ করা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার কাজ নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক দায়িত্ব। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগে কিশোরদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

 ৬ দাবিতে রাস্তায় মাইলস্টোনের শোকাহত শিক্ষার্থীরা

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: বিসিবির শোক কর্মসূচি

উল্টো পথে আসা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা রাজউক চেয়ারম্যানের

ঘুম থেকে উঠেও ক্লান্ত, বড় কোনো সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে কি শরীর?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত

ভয়াবহ দুর্যোগে পাকিস্তান, ২২১ জনের মৃত্যু

জয়াকে দেখে খেপলেন বিজেপি নেতা

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত, ২০ জনের মরদেহ হস্তান্তর

মৃত্যুর কাছে হার মানল অগ্নিদগ্ধ ছাত্র উক্য চিং মারমা

নিহত ২৭ জনের মধ্যে ২৫ জন শিশু : ডা. সায়েদুর

১০

সুলতান’স ডাইনে হসপিটালিটি স্টাফ পদে চাকরির সুযোগ

১১

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত / নিখোঁজ শিশু রাইসাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পরিবার

১২

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত / হতাহতের সংখ্যা গোপনের দাবি সঠিক নয় : প্রেস উইং

১৩

৪৯তম বিশেষ বিসিএসের আবেদন শুরু আজ

১৪

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ২৩ দেশের বিবৃতি

১৫

২২ জুলাই: আজকের রাশিফলে কী আছে জেনে নিন

১৬

মুক্তিপণ দিয়েও নূরকে জীবিত পেল না পরিবার

১৭

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তে নিহত বেড়ে ২৭

১৮

পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রসঙ্গে ইরানের সিদ্ধান্ত জানালেন আরাঘচি

১৯

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত, ৮ মরদেহ হস্তান্তর

২০
X