শ্যামা সরকার
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১০:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নৈতিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবক্ষয়

নৈতিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবক্ষয়

বুদ্ধি ও বিবেকবোধের সমষ্টিগত রূপ মন, যা প্রতিক্ষণে পরিবর্তনশীল। চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনা মানসিক ক্রিয়াকলাপ। এটি শারীরিক ভিত্তি নয়, বরং মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত। মন আর মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের মন অভ্যন্তরীণ আচরণ ও আবেগের সমষ্টি। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক—এ তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়। বর্তমান সময়ে নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের অবক্ষয়, যা গবেষণা প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে।

গবেষণায় (Priory, ২০২৪) দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে ৪ জন পুরুষ তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কখনো কথা বলেনি এবং সেখানে ২৯ শতাংশ পুরুষ বলেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা তাদের জন্য বিব্রতকর। ২০ শতাংশ পুরুষ নিজের মানসিক অনুভূতি নেতিবাচক স্টিগমার কারণে কথা বলেন না। ১৭ শতাংশ পুরুষ তাদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না এবং ১৬ শতাংশ পুরুষ মনে করেন সে এ বিষয়ে কথা বললে তাকে দুর্বল ভাবা হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৮ জনে ১ জন পুরুষের মধ্যে নানা মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, যেখানে প্রতি ৫ জনে ১ জন নারী। নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সংকোচ এবং সামাজিক স্টিগমা, এসবের ফলে মানসিক স্বাস্থ্যে পুরুষদের নানা ঝুঁকি তৈরি হয়।

এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে পুরুষরা ঝুঁকিতে বেশি। এ বিষয়ে তারা যত্নশীল তো নয়ই বরং উদাসীন। ফলে বাড়ছে সহিংসতা ও অপরাধপ্রবণতা। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা এবং তা ধারণ করেছে ভয়াবহ আকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণ ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও সহিংসতার মানসিকতা থেকে সংঘটিত হয়। জোরপূর্বক ও লালসা। এটি জঘন্য অপরাধ। ধর্ষণ শুধু শারীরিক নয়, বরং এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অপরাধ। প্রয়োজন মানসিক গঠন, আবেগ, প্রেরণা ও সামাজিক পরিবেশ বিশ্লেষণ।

নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা গুরুতর হয়, সেসব উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে। এর বাইরে অনেক খবর আড়ালেই থেকে যায়। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বিষয়ে ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছর নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৮৬১টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণ, ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করে ছয়জন।

৮ মার্চ পালন করা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান ‘For ALL women and girls : Rights, Equality, Empowerment’. এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে: ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। এ প্রতিপাদ্যে সারা দেশে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সবচেয়ে গর্বের ও আনন্দের বিষয় এ দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে বিভিন্ন সেক্টরে তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অদম্য নারী পুরস্কার-২০২৫’ গ্রহণ করেছেন গর্বিত পাঁচ নারী। ওইদিনই (৮ মার্চ) গাজীপুরের শ্রীপুরে কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার, ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় মোজাম্মেল হক মানিক নামের এক শিক্ষক, ফরিদপুরে কন্যাশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, রাতে কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ৬ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার, ৭ মার্চ সাতক্ষীরার কলারোয়ায় প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, ৯ মার্চ গাজীপুরে আট বছরের কন্যাশিশুকে ধর্ষণ, সীতাকুণ্ডে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মায়ের মামলা, নরসিংদীতে তিন দিন আটকে রেখে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এ চিত্র (শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, প্রতিবন্ধী তরুণী কেউই রেহাই পাননি যৌন নির্যাতন থেকে) প্রতিটি অভিভাবকের জন্য দুঃসহ যন্ত্রণা। একাধারে নারীর স্বীকৃতি, অন্যদিকে নারীর অবমাননা। হাস্যকরই বটে! সুশীল সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের অবচেতন মনে কি কোনো ধরনের চেতনার উদ্রেগ হচ্ছে? এক কন্যাসন্তানের পিতা/মাতার/স্বামীর আর্তনাদ কি তাদের মনকে বিচলিত করে?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের ২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকারের যে পরিসংখ্যান, তা ভয়াবহ।

লেখার শুরুতেই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। মানসিক ভারসাম্য হারালে একজন পুরুষ মানুষ কী কী কারণে ধর্ষক ও ধর্ষণ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়, তা স্পষ্টতই ফুটে ওঠে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায়: ক্ষমতালিপ্সু, প্রতিহিংসাপরায়ণ, স্যাডিস্টিক, সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, সহানুভূতির অভাব ও ব্যক্তিত্ব সংকট, শৈশবকালীন ট্রমা ও পারিবারিক পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির ভূমিকা, মাদক ও অ্যালকোহলের প্রভাব। ধর্ষকদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যক্তির মধ্যে সাইকোপ্যাথিক বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। সব সাইকোপ্যাথ ধর্ষক নয়, তবে তাদের অপরাধমূলক আচরণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাইকোপ্যাথরা সাধারণত পরিকল্পিত ধর্ষণ করে এবং এ ধরনের অপরাধীদের চিহ্নিত করে মানসিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।

এসব কিছুই একজন ব্যক্তির নৈতিক স্খলন ঘটতে সহায়ক। তবে এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা ব্যক্তিজীবনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। নৈতিক শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আত্মসম্মানবোধ এগুলো পারিবারিক শিক্ষা। এ মানবীয় পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা একটি শিশুসন্তান অবশ্যই একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। হতে পারে একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। একজন মানসিক সুস্থসম্পন্ন ব্যক্তি অনেক বেশি সার্থক। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ থাকা জরুরি।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলীর মতে, ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার সামজের ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখতে বাধ্য হয়। তথাপি বর্তমানে ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেকেই সাহস করে মামলা করছেন। নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও অপরাধকে ছোট করে দেখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। অন্যদিকে, মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তদন্ত করা, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রতিবেদন দেরিতে দেওয়া, বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ বাড়ছে। ফলে নারী ও কন্যশিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

এদিকে, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর ধর্ষণের মামলার বিচার ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ সনদ প্রয়োজন হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন, শুধু চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি সেরকম ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তাল সারা দেশ। বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ করে ধর্ষক ও নিপীড়কদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষসহ শোবিজ অঙ্গনের তারকারা এতে সংহতি প্রকাশ করেন। নৈতিকতা, মূল্যবোধ আজ ভূলুণ্ঠিত। ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সহমত পোষণ এসব হারিয়ে ফেলছে মানুষ। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা ও অরাজকতা। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতা। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। সুস্থ পরিবেশ মানেই মানসিক স্বাস্থ্যের উৎকর্ষতা। তৈরি হবে ‘বোধে’র জায়গা। দূর হবে অমানিশা।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও প্রধান কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-উদ্দীপন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

০২ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

টিকাটুলিতে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

বিয়ের প্রলোভনে ‘ধর্ষণ’, পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার

পরীক্ষায় নকল সরবরাহ করতে যান ছাত্রদল নেতা, অতঃপর...

ছাত্রীদের হলে পুরুষ স্টাফ দিয়ে তল্লাশি

দাম কমলো ইন্টারনেটের

ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভাবার অনুরোধ তারেক রহমানের

বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ

জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ

১০

শাহজালালে বোয়িং বিমানে লাগেজ ট্রলির আঘাত

১১

আখতারকে রংপুর-৪ আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা

১২

মধ্যরাতে বরখাস্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার

১৩

‘একসঙ্গে সমুদ্রে নেমে তো গোসল করতে পারব না’

১৪

জুলাই যোদ্ধার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম ২ জায়গায়

১৫

বিএনপির অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর ঘটনায় মির্জা ফখরুলের প্রতিবাদ

১৬

রাজধানীতে শ্রমজীবী মানুষের মাঝে লায়ন্স ক্লাবের খাবার বিতরণ

১৭

জামায়াত-গণঅধিকার পরিষদের মতবিনিময় / নির্বাচনী জোট গঠনে একমত

১৮

উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ, মাদ্রাসার সুপার কারাগারে

১৯

তারেক রহমান নেতৃত্ব না দিলে জুলাই আন্দোলন সফল হতো না : মুরাদ

২০
X