ববি হাজ্জাজ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর পড়াকালীন থেকে তিনি দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখছেন। তিনি একাধিক রাজ্য সিনেট এবং গভর্নারেটাল নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এমবিএ করেন। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূরে আলম সিদ্দিকী
কালবেলা: ছাত্র-জনতার আন্দোলন-পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে এনডিএমের অবস্থান কী?
ববি হাজ্জাজ: বহু বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে এনডিএম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। রাজপথে আমরা আওয়াজ তুলেছি। এর জন্য অনেক অত্যাচার-অনাচার সহ্য করতে হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর নতুন সূর্যের মুখ দেখার প্রেক্ষাপটে আমাদের সবার চাওয়া অনেক বেশি ছিল। আমাদের প্রথম চাওয়া ছিল জনগণের অধিকারের বাস্তবায়ন। আর সেই অধিকার বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হলো নির্বাচন।
গত সাত-আট মাস অন্তর্বর্তী সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। তার জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা যেমন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য একটি নির্বাচিত সরকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই আট মাসে আমরা এখনো পরিষ্কার হইনি যে, কবে নির্বাচন হবে।
অনেকেই বলছেন যে নির্বাচন পিছিয়ে দাও, রমজান যেমন ভালো গেছে সবসময় তেমন ভালো যাবে। রোজার মাসের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যেমন ধন্যবাদ জানানো দরকার, একই সঙ্গে এ উপলব্ধিটাও দরকার দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা সম্ভব নয়। অর্থনীতিকে চলমান রাখতে ও শক্তিশালী করতে সবচেয়ে জরুরি হলো স্থিতিশীলতা। কোনো ব্যবসায়ী যখন দেখবে, সরকার যে কোনো সময় বদলাতে পারে, তখন সে বিনিয়োগ করার আগে কয়েকবার চিন্তা করবে। বিদেশিরা তো বিনিয়োগ করবেই না। বিদেশিরা যদি বিনিয়োগ না করে, দেশি ব্যবসায়ীরাও যদি বিনিয়োগ না করে তাহলে ব্যবসা চলবে কীভাবে।
কালবেলা: নতুন দল এনসিপি সম্পর্কে এনডিএমের অবস্থান কী?
ববি হাজ্জাজ: রাজনৈতিক মহলে নতুন দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)কে আমরা সাধুবাদ জানাই। তরুণরা মিলে একটি দল করেছে। এনসিপির সমালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, তারা প্রথম থেকেই একটা আওয়াজ তুলেছিল যে জুলাই আন্দোলনের একক ক্রেডিট তাদের। তারা ক্রেডিট ডিজার্ভ করে এটা সত্য, কিন্তু তাদের সঙ্গে আরও লাখ লাখ মানুষ আছেন যারাও ক্রেডিট পাবেন। তারা যদি বলত যে ‘আমরাও’ ক্রেডিট ডিজার্ভ করি তাহলে সমস্যা ছিল না। এই দলটার এখন পর্যন্ত কোনো অফিসিয়াল ডিক্লারেশন নেই, অফিসিয়াল কোনো কনস্টিটিউশন নেই, অফিসিয়াল কোনো স্টেটমেন্ট নেই। এনসিপির প্রতি আমার অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখজনক তারা তাদের ভুলগুলো কাটিয়ে উঠছে না।
কালবেলা: সংস্কার ও নির্বাচন সম্পর্কে এনডিএমের অবস্থান কী?
ববি হাজ্জাজ: শুনছি যে অল্প সংস্কার হলে নির্বাচন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তো অল্প সংস্কার মানে কী? কার মতের ওপর ভিত্তি করে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে এটাই অল্প সংস্কার? এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। আপনি যদি বলেন যে এনসিপি মানলে তবে আমরা মানব, তখন একটা প্রশ্ন আসবে যে কেন এনসিপি মানলে আপনারা মানবেন। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানটা সবার সামনে পরিষ্কার করতে হবে। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কালবেলা: কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি?
ববি হাজ্জাজ: সংস্কার ও নির্বাচন কখনোই সাংঘর্ষিক ছিল না, এখনো সাংঘর্ষিক নয়। এই আলোচনা যারা সবার সামনে এনেছেন তারা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছেন বলে আমার মনে হয়। সরকারের ভেতর থেকে দুয়েকজন উপদেষ্টা এমন কথাও বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কার করতেই পারত তাহলে গত ৫৩ বছরে কেন তারা করেনি। যারা এ কথাগুলো বলেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ কাজ করেছে বলে আজ বাংলাদেশ এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি না। আশপাশের অনেক দেশ এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে যখন শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছিল তখন বাংলাদেশ তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। তবে বিগত সরকার যেভাবে লুটপাট করেছে তাতে বাংলাদেশ বর্তমানে কিছুটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু আমরা ভঙ্গুর দেশ না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশগুলো তৈরি করেছিল, তারা অনেক সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। এ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এনডিএম এ প্রস্তাবের দুই-তৃতীয়াংশের সঙ্গে একমত। আমার দল এনডিএম ১৬৬টা প্রস্তাবের মধ্যে ১২০টির সঙ্গে একমত হয়েছে।
তবে এসব প্রস্তাবের মধ্যে এমনকিছু বিষয় আছে, যা পরিবর্তনের জন্য সংবিধানে হাত দিতে হবে। সংবিধানে হাত দেওয়ার প্রশ্ন যখন আসে তখন নির্বাচন ছাড়া তা সম্ভব নয়। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক সব দল আমরা একমত যে, সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সেটার জন্য নির্বাচন লাগবে। সব তো আর মুখের কথা নয়, আইনি জটিলতা আছে। সুতরাং সংস্কার করতে চাইলেও নির্বাচনটা জরুরি।
কালবেলা: প্রশাসনিক সংস্কার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে এনডিএমের পরামর্শ কী?
ববি হাজ্জাজ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামোগত অনেক ধরনের সংস্কার দরকার। এটার জন্য আমরা আমাদের দল থেকে একটি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। পুলিশ বাহিনীকে সাজানোর জন্য সর্বপ্রথম পুলিশ অ্যাক্টে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া পেনাল কোড আমরা এখনো অনুসরণ করছি। আমরা দুই-আড়াইশ বছরের পুরোনো নিয়মকানুন এখনো অনুসরণ করে যাচ্ছি। এজন্যই আমরা ভুল পথে হাঁটছি। এগুলোতে পরিবর্তন দরকার। গত ১৫ বছরে স্বৈরাচার সরকার পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছিল। একই সঙ্গে পুলিশ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল। এই পুলিশ সংস্কার রাতারাতি হবে না। এ সংস্কার করতে হলেও একটা শক্ত রাজনৈতিক সরকার দরকার।
কালবেলা: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে এনডিএমের অবস্থান কী?
ববি হাজ্জাজ: আমরা প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছি। আমরা হাইকোর্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের জন্য। নাগরিক হিসেবে আমাদের পুরো অধিকার আছে রাজপথে নামার, আন্দোলন করার। কিন্তু আন্দোলনে যদি আইনবহির্ভূত কিছু চাই সেটা বাস্তবায়ন হয়ে যাবে সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে আওয়ামী লীগকে কয়েকভাবে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
ছাত্রলীগকে যে আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগকেও সে আইনে নিষিদ্ধ করা যাবে। যেসব কারণ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে ছিল, সেসব একই কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপরও বর্তায়। সেসব কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিলুপ্ত করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন চাইলেই সেটা পারবে। ২০১৮ সালের ভোট কারচুপির অনেক প্রমাণ জনগণের কাছে আছে। এটার দায় সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগ দলের ওপর বর্তায়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই যারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ দেখতে চায় না। সবাই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ দেখতে চায়।
কালবেলা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনডিএম কি বিএনপির সঙ্গে জোট করবে?
ববি হাজ্জাজ: আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার। আমরা যদি সব আসনেও না পারি, তবুও যতগুলো আসনে প্রার্থী দেব সেসব প্রার্থী যেন ভালো হয় সে চেষ্টা করছি। যারা জনগণের সেবা করবে, জনগণের পাশে থাকে এবং থাকবে, তাদেরই অগ্রাধিকার দেব। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপিসহ যতগুলো বড় দল ছিলাম, তাদের প্রথম থেকেই প্রস্তুতি ছিল যে নির্বাচনে আমরা একত্রিতভাবে যাব। আমরা আশাবাদী এই প্রচেষ্টা সফল হবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না হয় ততক্ষণ নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
মন্তব্য করুন