মো. মামুন হাসান
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মৎস্য খাতের টেকসই অগ্রযাত্রা

মৎস্য খাতের টেকসই অগ্রযাত্রা

বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই নদীমাতৃক দেশ। মানুষের নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মধ্যেও সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও বাস্তবসম্মত নীতিমালার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন ও সুরক্ষায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। মৎস্য খাত শুধু আমিষ ও পুষ্টির জোগান নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, হাওর-বাঁওড়সহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৩৮.৬ লাখ হেক্টর এবং বদ্ধ জলাশয় রয়েছে ৮.৫ লাখ হেক্টর। তদুপরি, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমা আমাদের মৎস্যসম্পদের অন্যতম প্রধান ভান্ডার।

মৎস্যসম্পদের সংরক্ষণ, উন্নয়ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই আহরণ ও উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ দেশের মৎস্য খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ধারাকে আরও শক্তিশালী করতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’—শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি আমাদের টেকসই উন্নয়নের অঙ্গীকার। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) থেকে শুরু করে ২৮ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে একযোগে উদযাপিত হবে এটি।

মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, মাছসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করা সম্ভব। পাশাপাশি এর ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন আরও গতিশীল ও টেকসই হবে।

মৎস্য খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২.৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে ২২.২৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক ৫০ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার মধ্যে প্রায় ১২ লাখ নারী রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক মাছের প্রাপ্যতা ৬৭.৮০ গ্রাম, যা দৈনিক চাহিদা ৬০ গ্রাম থেকে বেশি। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মৎস্য খাত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ প্রথম, তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। FAO-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান মিঠা পানির মাছ আহরণে তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষে পঞ্চম, ক্রাস্টাশিয়ান (চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি) আহরণে অষ্টম এবং উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম।

বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ইলিশের ভরা মৌসুম। জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং টেকসই আহরণ নিশ্চিত করতে সরকারের গৃহীত Hilsa Fisheries Management Action Plan (Hilsa FMP) প্রণয়ন ও সফল বাস্তবায়ন, জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম জোরদারকরণ, ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ইলিশ অভয়াশ্রম ঘোষণা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার ফলে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। চলতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১২ জুন থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৪৬ হাজার ৭৯০ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ARIMA মডেল অনুসারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ৫ লাখ ৩৮ হাজার থেকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার টন হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো উৎপাদন হ্রাসের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে প্রকৃত উৎপাদন এ পূর্বাভাসের চেয়েও কম হতে পারে বলে সতর্কতা জানানো হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দাদনমুক্ত অর্থনীতির লক্ষ্যে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে বিদ্যুতের দাম কৃষি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

দেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে Marine Protected Area (MPA) ঘোষণা এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু রয়েছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে Marine Reserve, নিঝুমদ্বীপ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা এবং নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাগুলো সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। ফলে দেশের সামুদ্রিক জলসীমার ৮১০১ বর্গকিলোমিটার (৮.৬৪ শতাংশ) এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 14.5) অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এসব উদ্যোগ দেশের মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনে মৎস্য খাত বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজনন সুরক্ষায় ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা আগের ৬৫ দিনের পরিবর্তিত সময়কাল (এ বিষয়ে ১৬ মার্চ, ২০২৫-এ প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে)। সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ সংশোধন এবং মৎস্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইন ১৯৫০ সংশোধনের মাধ্যমে অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী ধারা ৭ যুক্ত করার ফলে মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী সংরক্ষণ করা যাবে (এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ২৯ জুন, ২০২৫-এ জারি হয়েছে)। বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিরলস গবেষণার ফলে মিঠা পানির বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ৪১টি প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি সফলভাবে উদ্ভাবিত হয়েছে। একদিকে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে; অন্যদিকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, নদী ও জলাশয়ের দূষণ, নদীর নাব্য সংকট ও ভরাট, প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস, দাদন ও ঋণনির্ভর জেলে পেশা, অসচেতনতা ও আইন অমান্য করাসহ বিভিন্ন কারণে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। তাই মাছের উৎপাদন ধ্বংসের বহুমুখী কারণ বন্ধে এবং মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি সব স্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মৎস্য খাত আজ শুধু পুষ্টির জোগানদার নয়, বরং দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। সরকারি বাস্তবমুখী উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং জনগণের অংশগ্রহণের ফলে মৎস্য খাত টেকসই উন্নয়নের পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। পুষ্টি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় মৎস্য খাতকে করি আরও শক্তিশালী—সকলে মিলে গড়ি টেকসই ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্তানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি জায়েজ

৩১ দফার আলোকে হবে রাষ্ট্র গঠন : অমিত

খালেদা জিয়াকে দেখতে ফিরোজায় যাবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

ঘুষকাণ্ডে এবার জামায়াতের সেই আইনজীবীর সনদ স্থগিত

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন, আলোচনা হবে যেসব ইস্যুতে

চাঁদাবাজির অভিযোগে ২ যুবককে গণপিটুনি

সেই তন্বীর বিরুদ্ধে লড়বেন জান্নাতুন নাহার

দুই বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল হেলপারের

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুতে সিইউজে’র শোক

রাজধানীর পান্থপথে দেয়াল ধসে নিহত ১

১০

কালকিনিতে আনিসুর রহমান খোকন / মায়েদের পাশে থাকবে বিএনপি

১১

দিনে কত কাপ চা খাওয়া উচিত, জানালেন বিশেষজ্ঞ

১২

২০২৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সিলেবাস কেমন হবে, জানা গেল

১৩

শান্ত-সৌম্যর বাদ পড়ার কারণ জানালেন গাজী আশরাফ

১৪

বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

১৫

‘এখন কাউকে ধরতে যৌক্তিক কারণ লাগে না, তবে সত্যের জয় হবে’

১৬

হাওরে নৌকা ডুবে নিখোঁজ ২

১৭

‘পৃথক সচিবালয় ছাড়া বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়’

১৮

রাতের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৯

বেসরকারি সংস্থায় চাকরি, বেতন ৩৮০০০ টাকা

২০
X