চলে গেলেন আহমদ রফিক। তিনি এখন আমাদের সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার এ চলে যাওয়া একেবারে আকস্মিক নয়। বার্ধক্য তাকে ঘিরে ধরেছিল অনেক দিন আগেই। বেশ কিছুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। খবর পেয়েছিলাম হাসপাতালে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাই মনকে তৈরি করে নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবু শেষ হতে থাকা এবং শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কতটাই না তফাত।
আহমদ রফিকের প্রধান পরিচয় তিনি সাহিত্যিক। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি অসাধারণ রকমের সৃষ্টিশীল। কিন্তু ওই পরিচয়ের ভেতর আরও পরিচয় রয়েছে। প্রথম কথা, তিনি শুধু সাহিত্যিক নন, অঙ্গীকারবদ্ধ সাহিত্যিক। তার অঙ্গীকার শুধু সাহিত্যের প্রতি নয়, সাহিত্যকে সামাজিক করে তোলার ব্যাপারেও। তার সাহিত্যচর্চা সামাজিক অঙ্গীকারেরই অংশ।
মনের আনন্দেই তিনি লিখতেন। যে কাজ সব সাহিত্যিকেরই কিন্তু যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হলো—নিজের আনন্দ তিনি নিয়ে যান সমাজের কাছে। সেদিক থেকে তার মূল ভূমিকাটা হয়ে দাঁড়ায় সাংস্কৃতিক। সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন। আর এটা তো আমরা সবাই জানি যে, আমাদের সংস্কৃতি নানা কারণে পশ্চাৎপদ, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সংস্কৃতিকর্মীরা ভূমিকা রাখতে পারেন; ভূমিকা থাকা দরকার রাজনীতিকদের, খুব বড় দায়িত্ব থাকে সাহিত্যিকদের। সাহিত্যিক হিসেবে আহমদ রফিক আজীবন এবং ক্লান্তিহীন রূপে ওই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি কাজ করেছেন। তার প্রধান পরিচয় কবি হিসেবে, কিন্তু তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন বহু বিষয়ে, বিশেষ করে সংস্কৃতি ও সমাজ বিষয়ে। এখনো তিনি কলাম লেখেন সংবাদপত্রে। তার প্রবন্ধে গবেষণা থাকে এবং রবীন্দ্র-গবেষক হিসেবে অত্যন্ত বড় মাপের ও খুবই উপকারী কাজ করেছেন তিনি।
আহমদ রফিক ছাত্র ছিলেন বিজ্ঞানের, তিনি অধ্যয়ন করেছেন চিকিৎসাবিদ্যা এবং পেশায় চিকিৎসক না হলেও পেশাজীবনে চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিজ্ঞানের গুণ হচ্ছে বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ, সে গুণ দুটিকে তিনি নিয়ে এসেছেন তার সাহিত্যচর্চায়। তার সাহিত্যে দেখি নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিকতা। নান্দনিকতা ও বৈজ্ঞানিকতার ভেতরে একটা বিরোধ আছে, থাকারই কথা; কিন্তু ওই দুটি যখন নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার ভেতরে একত্র হয় একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে, ওই সম্পর্ক সমৃদ্ধ করে সৃষ্টির নান্দনিকতাকে।
আহমদ রফিকের সাহিত্য সৃষ্টিতে ওই ঘটনা ঘটেছে। বৈজ্ঞানিকতা সেখানে সাহায্য করেছে নান্দনিকতাকে, আত্মপক্ষ সমর্থন করে নয়, দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। সেজন্য দেখা যায় যে, তার প্রতিটি সৃষ্টির ভেতরেই বৈজ্ঞানিকতা আছে। রয়েছে স্বচ্ছতা, যুক্তির পারম্পর্য ও দৃঢ়তা। তিনি আবেগের সঙ্গে লেখেন, তার আছে সৌন্দর্য কল্পনা কিন্তু তার লেখায় আড়ম্বর থাকে না, ওজস্বিতা প্রশ্রয় পায় না, আবেগ ও কল্পনা প্রবহমান থাকে স্বতঃস্ফূর্ত অথচ সুশৃঙ্খল গতিতে। আমাদের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এমন ঘটনার প্রাচুর্য নেই।
আহমদ রফিকের সামাজিক অঙ্গীকার তাকে সাংস্কৃতিক জগতে সর্বদাই কর্মব্যস্ত রেখেছে। ছাত্রজীবনে তিনি ভাষা আন্দোলনে জরুরি ভূমিকা পালন করেছেন। ওই আন্দোলনের কথা তার বহু লেখায় পাওয়া যাবে। ভাষা আন্দোলনের ভেতরে ছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। সে রাষ্ট্রের হওয়ার কথা ছিল যথার্থ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ এবং নাগরিকদের ভেতরে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আবশ্যক ছিল একটি সামাজিক বিপ্লবের। আহমদ রফিক ভাষাসংগ্রামে যোগ দিয়েছেন সমাজবিপ্লবের স্বাপ্নিক হিসেবেই, এর চেয়ে খাটো কোনো লক্ষ্যে নয়।
আমরা জানি যে, তিনি সমাজবিপ্লবের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজ করেছেন ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে। একসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিরও সদস্য ছিলেন এবং নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল থেকেছেন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে লিখেছেন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
লেখকদের জন্য সমাজসংলগ্নতার যে প্রয়োজন রয়েছে, সে ব্যাপারেও আহমদ রফিকের উপলব্ধির একটি প্রমাণ সংবাদপত্রে তার লেখা। একসময় তিনি একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে উদ্যোগ সফল করা সহজ ছিল না, সফল হয়নি এটাও সত্য, কিন্তু নাগরিক নামে তিনি যে একটি উচ্চমানের মাসিক পত্রিকা অনেকটা একক প্রচেষ্টাতেই বেশ কিছুটা সময় ধরে প্রকাশ করেছেন, সে ঘটনাকে কোনোমতেই সামান্য বলা যাবে না।
২০১৭ সালে আমরা অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন করেছি। আয়োজকরা প্রথমেই তার কাছে গেছেন নেতৃত্বদানের অনুরোধসহ। সে অনুরোধে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না এবং উদযাপনের সব প্রক্রিয়ায় তার যে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা, সেজন্য বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহীরা তার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ওই উদযাপনে তার সঙ্গে কাজ করাটা ছিল আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। তিনি তার কর্মক্ষেত্রে যেমন সপ্রতিষ্ঠ, তেমনি অন্যদের জন্যও দৃষ্টান্ত।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন