বলার মতো বলতে থাকলে, কাজ না হওয়া পর্যন্ত যৌক্তিকভাবে তাগিদ দিতে থাকলে ফলাফল আসে, তা কিছুটা প্রমাণ হলো হজ ব্যবস্থাপনায়। তা শুধু দেশে নয়, হজের আয়োজক দেশ সৌদি আরবেও। আসন্ন হজ মৌসুমের সাত-আট মাস আগেই বড় ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে দেশটির হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে তারা ব্রিফ করেছে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকেও। বাংলাদেশে এরই মধ্যে সরকারি প্যাকেজ ঘোষণার পর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় তিনটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা হয়েছে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে হজ হবে ২৬ মে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালনের সুযোগ পাবেন। হজের প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু হয়েছে ২৭ জুলাই থেকে। চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাব ঘোষিত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এবার হজযাত্রীদের জন্য খাওয়া ও কোরবানিসহ তিনটি হজ প্যাকেজের খরচ জানানো হয়েছে সবিস্তারে। এর মধ্যে বিশেষ হজ প্যাকেজে খরচ পড়বে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সাধারণ প্যাকেজে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর সাশ্রয়ী হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। গত বছরের তুলনায় এবার সাধারণ প্যাকেজের ব্যয় বেড়েছে ২৭ হাজার টাকা। গত বছর এই প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এই বাড়তি খরচেরও ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রতি সৌদি রিয়াল ৩২ টাকা ৮৫ পয়সা ধরে প্যাকেজের খরচ হিসাব করা হয়েছে।
সৌদি আগের চূড়ান্ত ব্যয়ের হিসাব না পাওয়ায় বিগত বছরের ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য খরচ হিসাব করে হজ প্যাকেজগুলো করা হয়েছে। পরে রাজকীয় সৌদি সরকার কর্তৃক কোনো খাতে খরচ বৃদ্ধি বা কমানো হলে প্রযোজ্য খাতের বর্ধিত বা হ্রাসকৃত ব্যয় প্যাকেজ মূল্য হিসেবে গণ্য হবে এবং হজযাত্রীকে তা পরিশোধ করতে হবে এবং একই সঙ্গে বিমানভাড়া কমলে তা প্যাকেজ মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এ বছর কোরবানির অর্থ নুসুক মাসার প্ল্যাটফর্মে পরিশোধ বাধ্যতামূলক হওয়ায় সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমের প্যাকেজে কোরবানির অর্থ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর হজযাত্রীর বিমানভাড়া বাংলাদেশ অংশের ট্যাক্স ও চার্জ ছাড়া ধরা হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের খাবার খরচ প্যাকেজের বহির্ভূত থাকলেও, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় উন্নত সার্ভিসের জন্য খাবারের মূল্য প্রতিটি প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আগের চেয়ে বড় তফাত হচ্ছে, বিমান ভাড়া কমেছে ১৩ হাজার টাকা। হাব মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার জানান, তাদের চেষ্টা ও দাবি হচ্ছে এ খরচ আরও কমিয়ে আনার।
সৌদি খরচ বেড়েছে বা বাড়ানো হয়েছে বলে একটি যুক্তি আছে। রয়েছে অভিযোগ-আক্ষেপও। বিষয়টি ধর্মীয় বিধায় শেষতক চেপে যেতে হয়। কোনো দেশ এ নিয়ে বার্গেনিংয়ে না গিয়ে ইচ্ছেমতো বাড়তি খরচ উসুল করে হজযাত্রীদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ সরকার এবং হজ এজেন্সি এসব নিয়ে কথা বলতে শিখেছে। আগের সরকার ও বেসরকারি আয়োজকরা লুটের ধাঁচে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। যেমন এখন রেট ১২২.৫০ টাকা আর টিকিট মূল্য ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৩০ টাকা। অথচ ডলার রেট যখন ১০০ টাকা ছিল, তখন টিকিট মূল্য ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। সেই হিসাবে টিকিট মূল্য ১ লাখ ৫৪ হাজার না হয়ে অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হওয়ার কথা। তা হয়নি। প্রতি বছর বিশেষ ও সাধারণ ক্যাটাগরিতে দুটি হজ প্যাকেজ থাকলেও, এ বছর সাশ্রয়ী নামে আরেকটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, বিশেষ হজ প্যাকেজের জন্য হজ গমনেচ্ছুদের গুনতে হবে ৭ লাখ ৫০ হাজার, সাধারণ প্যাকেজের জন্য ৫ লাখ ৫০ হাজার এবং সাশ্রয়ী প্যাকেজের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এর আগে সরকারি হজ প্যাকেজ ঘোষণা অনুযায়ী, প্যাকেজ-১-এর মাধ্যমে হজ পালনে খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৯৭ টাকা। এ ছাড়া হজ প্যাকেজ-২-এ ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৮১ এবং হজ প্যাকেজ-৩-এ ৪ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৭ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। ২০২৫ সালে হজযাত্রীদের বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। ২০২৬ সালের বিমানভাড়া নির্ধারণের আগে হাব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিমানভাড়া কমানোর আবেদন করে। হজসংক্রান্ত সব সভায়ও বিমানভাড়া কমানোর দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৬ সালে হজে বিমানভাড়া ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১২ হাজার ৯৯০ টাকা কম। আজিজিয়া প্যাকেজ নামে পরিচিত প্যাকেজটি এবারের বিশেষ দিক। এটির বাড়ির দূরত্ব হবে হারাম শরিফ থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াত করা যাবে বাসে। বিগত বছরগুলোতে ডেডিকেটেড ফ্লাইটের ভাড়া নিলেও এয়ারলাইনসগুলো শিডিউল ফ্লাইটেও হজযাত্রী পরিবহন করেছে। এবার নির্ধারিত ফ্লাইটের ভাড়া পরিশোধের সুবাদে হজযাত্রীদের সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন ঢাকায় নিশ্চিত করতে সব হজ ফ্লাইট নির্ধারণ হবে বলে আশা করা যায়। কোনোভাবেই কোনো শিডিউল ফ্লাইটে হজযাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং এর মাধ্যমে পাপমুক্তি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ হয়। হজের শাব্দিক অর্থ ‘জিয়ারতের সংকল্প’। আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসে বলেই এর নাম রাখা হয়েছে হজ। মুসলিম সম্প্রদায়ের ইবাদতগুলোর মধ্যে হজ হচ্ছে অর্থসাপেক্ষ। এর সঙ্গে অর্থের অনেক সম্পর্ক। আবার হজের ধর্মীয় বিধানও বেশ শক্ত। শারীরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করলে কঠোর শাস্তির কথা বলা আছে। অন্যদিকে, আয়োজক দেশ সৌদি আরবে হজ যেমন ইবাদত, তেমন অর্থনীতিও। হজের সময় সৌদি আরবে হয় বিশাল লেনদেন। সৌদি আরবের অর্থনীতিতে তা একটি বিশাল যোগ। এক হিসাব বলছে, গত বছর মোট ৮৩ লাখ মানুষ হজ করতে গেছেন। তাদের মধ্যে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ ওমরাহ পালনেও গেছেন। গত বছর হজ থেকে সৌদি আরবের সরাসরি রোজগার হয়েছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি যাওয়া হজযাত্রীরা মোট ২৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন ওখানে গিয়ে।
এ অর্থের একটা বড় অংশ সৌদি অর্থনীতিতেই যোগ হয়। মক্কার চেম্বার অব কমার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাইরের দেশ থেকে আসা মুসলমানরা মাথাপিছু ব্যয় করেন ৪ হাজার ৬০০ ডলার আর স্থানীয়রা মাথাপিছু প্রায় ১ হাজার ৫০০ ডলার ব্যয় করেন। একেক দেশ থেকে আসা হজযাত্রীদের জন্য আবার একেক রকম খরচ। বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়েই হজ করা যায়। প্রতিটি দেশ থেকে কত মানুষ হজে আসবেন, তার একটা কোটা নির্ধারণ করে দেয় সৌদি আরব। সৌদি আরবের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশও হজে যান। খরচ করতে হয় সবারই। হজে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যেতে হলেও সারা বছর ধরে ওমরাহ করতে যাওয়া যায়। সৌদি আরবের হিসাব অনুযায়ী, আগামী চার বছরের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে ১ কোটি ২০ লাখ হয়ে যাবে। এ বাস্তবতায় সৌদি আরব এমন একটি স্থায়ী জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হজ ও পবিত্র দুই মসজিদের ইতিহাস সংরক্ষণ করবে। দেশটির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে এটি একটি বড় পদক্ষেপ, সংস্কারও। হজ ও পবিত্র দুই মসজিদের ইতিহাস সংরক্ষণ প্রকল্পের উচ্চতর পর্ষদের এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর পরিকল্পনা। এ নিয়ে প্রিন্স ফয়সাল বিন সালমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বলা হয়, জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো শতাব্দী কাল ধরে চলে আসা হজের ইতিহাস এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর পরিষেবায় পরিবর্তনের বিবরণ তুলে ধরা। জাদুঘরটি পবিত্র দুই মসজিদ এবং হাজার বছর ধরে চলে আসা হজের ইতিহাসবিষয়ক জ্ঞানের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করবে, বিশেষত হজের আচার, রীতি ও সেবাগুলোতে যে পরিবর্তন সাধন হয়েছে, তা তুলে ধরা। এ ছাড়া সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘হজ ও পবিত্র দুই মসজিদবিষয়ক বিশ্বকোষ’ শীর্ষক একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বকোষ প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। একদিকে সৌদি আরবের এমন অগ্রসর চিন্তা, অন্যদিকে দেশে দেশে হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার তাগিদ ছিল অনেক দিনের।
একটি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এতে শামিল হয়েছে এবার। ধর্মীয়ভাবে হজ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা এবং তার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের ইবাদত। আর আয়োজন হিসেবে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিগত আমলসহ সময়ে সময়ে যন্ত্রণা-জটিলতা যেন হজের অংশ হয়েই থেকেছে। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে, তারা নিজ অর্থব্যয়ে জীবনে একবারের জন্য হলেও হজ পালন করবেন। এ নিয়ে একতরফা বাণিজ্য ও হেলাফেলা করা লোকজনদের কাছে এটি কোনো বিষয়ই নয়। শুধুই একটি মৌসুমি ব্যবসা। ভিসা বিড়ম্বনা ছাড়াও হজযাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বয়স্ক নারী ও পুরুষকে ক্যাম্প থেকে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটিয়ে এয়ারপোর্টে যেতে বাধ্য করা, মুয়াল্লিমের জামানত প্রদানে গড়িমসি, রিপ্লেসমেন্ট ও বারকোডে টাকা খসানো, এমনকি আদম কারবার পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়েনি। এসবের একটা এনওসি সনদ যেন তারা নিয়েই রাখত। লিড এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সাব-এজেন্সিসহ আরও নানা মহল এতে জড়িত। নৈতিকতা বা ধর্মের ন্যূনতম ভয়ও তাদের স্পর্শ করে না। একক বৈশ্বিক মহাসমাবেশ হিসেবে হজের অবস্থান সবার শীর্ষে। পৃথিবীর ইতিহাসে হজের মতো এত বড় জনসমাগমের নজির নেই কোথাও। লাখ লাখ মানুষের ‘লাব্বাইকের’ এ মিছিলে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণও কম নয়।
বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার পর এজেন্সিগুলোর ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজে মক্কা-মদিনায় থাকা-খাওয়াসহ সার্বিক সেবার পরতে পরতে থেকেছে কামাই-রোজগার। নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক-রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও সিন্ডিকেটে একাট্টা সবাই। হজটা তাদের কাছে মনোপলি ব্যবসার মওকা। হজ অফিস ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের চোখের সামনেই চলেছে হজ এজেন্সিগুলো ও তাদের সংগঠন হাবের অনিয়ম ও অরাজকতা। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা চলে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। গেলবার সরকারের শতচেষ্টা, হজ এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্টদের ওয়াদার পরও ভিসা জটিলতাসহ বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যেই হজ করতে হয়েছে। এবার একটি আশা জাগানিয়া বাতাবরণ। এবার লক্ষণ ভালো, যা আপাতত স্বস্তির। বাকিটা অপেক্ষার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন