গাজা একটি দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য বাঁচা হয়ে উঠেছে এক চরম যুদ্ধ। খাদ্য, পানি, ওষুধ প্রায় সব মৌলিক জিনিসই অত্যন্ত ঘাটতির শিকার। এমন একটি সময়ে, মানুষের মৃত্যুকে শুধু যুদ্ধবিদ্ধ করার কাজ বলা যায় না বরং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের প্রতিফলন। বিশ্ব স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সতর্ক করেছে যে, গাজায় দুর্ভিক্ষ দৃশ্যমান স্তরে পৌঁছেছে।
গাজা উপত্যকা ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল এবং মিশরের দ্বারা কঠোর স্থল, সমুদ্র ও আকাশ অবরোধের শিকার। এ দীর্ঘ অবরোধ গাজার অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং নির্মাণসামগ্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থানীয় শিল্পায়ন সম্ভব হয়নি, বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশে। বর্তমান যুদ্ধ এ অবরোধের দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ তৈরি হওয়া মানবিক কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ইতিহাসের এ দীর্ঘ অবরোধের কারণেই গাজার মানুষ খাদ্য ও পানির মতো মৌলিক চাহিদার জন্য পুরোপুরি বহিরাগত সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
যখন যুদ্ধক্ষেত্রে বোমা ও গুলি ছাড়া অনাহারের চাপে মানুষ মারা যায়, তখন আমরা বলি যে—এটি শুধু যুদ্ধ নয়, এটি গণহত্যার একটি নতুন রূপ। গাজায় যুদ্ধ শুধু বন্দুক চালানোর সীমায় সীমিত নয়, এর সঙ্গে খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে জীবন অভিধ্বংস করা হচ্ছে। এটা পরিকল্পিত কাজ, যা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে (পালেস্তিনি) লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার পরিমাপের মাপকাঠিতে এ কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করা যায় না।
গাজা যুদ্ধ শুধু মানবজীবন নয়, সেখানকার ভঙ্গুর পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করেছে। বিপুল পরিমাণ বোমাবর্ষণ এবং ধ্বংসের ফলে মাটি, পানি ও বায়ুতে দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে, যা ভবিষ্যতে কৃষিকাজ এবং পানীয় জলের সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ক্ষতি গাজার মানুষের জন্য নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে, এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও এ প্রভাব বহাল থাকবে। পরিবেশগত পুনরুদ্ধার না হলে গাজার জনজীবন স্বাভাবিক করা প্রায় অসম্ভব।
বারবার উল্লেখ করা হয়েছে গাজার দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি মানবসৃষ্ট। বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মাঝে, উদাহরণস্বরূপ আন্তর্জাতিক খাবার কর্মসূচি অর্ধেক ভাঙার মতো ঘটনা ঘটেছে, যখন সাহায্যকারী রুট বন্ধ করা হয়েছে। স্বল্প রাস্তায় প্রবেশাধিকার বন্ধ থাকায় খাদ্য সরবরাহ ও পল্লবনিক কার্যক্রম চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে পৌঁছাতে না পেরে প্রাণ হারাচ্ছে।
বিশ্ব এখনো নীরব। পশ্চিমা দেশগুলো চিন্তা প্রকাশ করলেও সেই অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সাহায্য প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ‘মানবিক সাহায্য অবরোধ করা হয়’—এ অভিযোগও উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর নীরবতা একটি গুরুতর নৈতিক ব্যর্থতা। তারা যুদ্ধবিমুখ এ জনগোষ্ঠীর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি জাতির প্রতি সহমর্মিতা থাকলেও কূটনৈতিক পাঠ থেকে বাস্তবায়ন অনেকটাই ব্যর্থ। রাষ্ট্রসংঘ, এশীয় ও ইসলামী সংস্থা সত্ত্বেও অবরুদ্ধ গাজার সাহায্য প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জটিলতা অনেক সময় কার্যকর পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করে। শান্তি ও সহায়তার চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিশ্বজোড়া আন্দোলন বাধ্য করছে অনেক দেশ গাজার জন্য সমর্থন ঘোষণা করতে। শ্রাব্য ও দৃশ্য মাধ্যম, বিক্ষোভ, অনশন এসব উপায়ে মানুষ ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বার্থান্বেষণ করছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ‘মার্চ ফর গাজা’ ধরনের কর্মসূচি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। এ প্রতিবাদ মানবিক চাপ সৃষ্টি করে শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে ধাপ বাড়াতে পারে।
অবকাঠামো, বাড়িঘর ও কলকারখানা ধ্বংস হওয়ার কারণে গাজার অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পুনর্গঠনের জন্য শত শত কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে, যা আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া অসম্ভব। তবে, যতক্ষণ না স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অবরোধ তুলে নেওয়া হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ধরনের বৃহৎ পুনর্গঠন প্রচেষ্টাই টেকসই হবে না। এ অর্থনৈতিক শূন্যতা গাজার যুবসমাজকে আরও চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বিশ্ববাসী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। গাজার দুর্ভিক্ষ ও গণহত্যা সম্পর্কে অবহেলা করা যায় না। মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, সমাজ সবেই এখন সভ্যতার দায়িত্ব বলবৎ করতে হবে। সাহায্য পাঠানো, রাজনৈতিক চাপে অংশ নেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ উচ্চারণ করা এগুলো আজ মানবতার চূড়ান্ত পরীক্ষা।
এ ভয়াবহ সংকটের সমাপ্তি টানতে হলে প্রয়োজন কঠোর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ, শুধু শোক প্রকাশ নয়। গাজার দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা এবং মানবিক অবরোধ সভ্যতার এক চরম নৈতিক ব্যর্থতা। বিশ্বকে অবশ্যই ত্রাণ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ করতে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ী শান্তি। মানবতা আজ এক কঠিন পরীক্ষার মুখে, গাজার মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাধানই এ বিপর্যয়ের একমাত্র পথ।
মো. নূর হামজা পিয়াস, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন