দীপাবলি—শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসংখ্য দীপশিখার সারি, আলোকিত ঘরবাড়ি, ফুলে সজ্জিত আঙিনা আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত মানুষের মুখ। কিন্তু এ উৎসবের অন্তরালে লুকিয়ে আছে এমন এক চিরন্তন আধ্যাত্মিক বার্তা, যা শুধু বাহ্যিক আলোকসজ্জায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি আত্মার জাগরণ ও অন্তরের অন্ধকার দূর করার আহ্বান। দীপাবলি মূলত আলোর মাধ্যমে অন্ধকার জয়, সৎ-এর মাধ্যমে অসৎ পরাভব, জ্ঞানের মাধ্যমে অজ্ঞতার অপসারণ এবং ভক্তির মাধ্যমে ভোগের শুদ্ধি—এ চিরন্তন সত্যের প্রতীক।
শাস্ত্র অনুযায়ী, দীপাবলির উৎপত্তি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কা বিজয় ও চৌদ্দ বছর বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিবাহক। রাবণ নামক অসুররাজকে পরাজিত করে দেবী সীতাসহ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের দিনে সমগ্র অযোধ্যাবাসী আনন্দে মেতে ওঠেন। শহরের প্রতিটি গৃহে, রাস্তায়, মন্দিরে ও প্রাসাদে জ্বলে ওঠে অসংখ্য প্রদীপ। আলো, ভক্তি ও আনন্দে ভরপুর সেই রাত্রি যেন স্বর্গেরই এক প্রতিচ্ছবি। সেই ঐতিহ্যই আজও দীপাবলি উৎসবের মাধ্যমে আমরা পালন করি—আলোকের জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে।
কিন্তু কালের প্রবাহে এ উৎসবের বাহ্যিক জৌলুস যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ততই অনেক সময় অন্তরের আলো ম্লান হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি সাজাই, আলো জ্বালাই, কিন্তু অন্তরে রয়ে যায় হিংসা, লোভ, ঈর্ষা ও অস্থিরতার অন্ধকার। ভগবদ্গীতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আধ্যাত্মিক জীবনের মূল হলো মনকে স্থির ও শুদ্ধ রাখা। সেখানে বলা হয়েছে—
“যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা।
যোগিনো যতচিতস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ॥”
—ভগবদ্গীতা ৬.১৯
অর্থাৎ, যেমন বাতাসহীন স্থানে দীপশিখা স্থির থাকে, তেমনি আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত যোগীর মনও স্থির ও শান্ত থাকে। দীপাবলির প্রকৃত তাৎপর্য এখানেই—অন্তরে সেই স্থিতি ও শুদ্ধতার দীপ জ্বালানো, যা আমাদের চিত্তকে ঈশ্বরের প্রেমে উদ্ভাসিত করে। বাহ্যিক প্রদীপের আলো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু হৃদয়ের ভক্তির প্রদীপ অনন্তকাল জ্বলে থাকে।
এ উৎসবে আমাদের উচিত শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ অনুসরণ করা—সত্য, ন্যায়, করুণা ও ধর্মের পথে অটল থাকা। দীপাবলি যেন শুধু বাহ্যিক আলোকসজ্জা না হয়ে আত্মার পরিশুদ্ধির ও ভক্তিজাগরণের এক অধ্যায় হয়ে ওঠে। প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রার্থনা করতে পারি—এ আলো যেন আমাদের হৃদয় থেকে অজ্ঞান, অহংকার ও স্বার্থপরতার অন্ধকার দূর করে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে—“দীপ দানং সর্বপাপ প্রণাশনম্”। অর্থাৎ, ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রদীপ দান সব পাপ দূর করে। প্রদীপ জ্বালানো শুধু আচার নয়, এটি করুণা, জ্ঞান ও সহমর্মিতার প্রতীক। এভাবেই দীপাবলি হয়ে ওঠে মানবতার জাগরণের উৎসব।
আজ আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)-এর ভক্তবৃন্দ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দীপাবলি উদযাপন করেন নাম-সংকীর্তন, ভগবদ্গীতা পাঠ, প্রসাদ বিতরণ ও প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রকৃত আনন্দ প্রদর্শনে নয়, প্রার্থনায়; ভোগে নয়, ভক্তিতে।
চলুন, এ দীপাবলিতে আমরা সকলে এক প্রতিজ্ঞায় ঐক্যবদ্ধ হই—
আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি কোণে ভগবানের প্রেমের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করব।
যখন সেই আলো প্রতিটি মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়বে, তখনই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে আলোকিত হবে।
শুভ দীপাবলি! জয় শ্রীরামচন্দ্র! জয় শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র!
লেখক: সাধারণ সম্পাদক
ইসকন বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন