[পঞ্চম পর্ব]
নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম বছরেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয় ঠিক এই কারণেই। ‘লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার’ প্রতিবাদে ১৯৪৭ সালের জুনে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক দল গণ-আজাদী লীগ। যার আহ্বায়ক ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ। তবে এটি গণ-সংগঠনে কখনোই রূপলাভ করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে। এর কিছুকাল পরই রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। যার পরিণতিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে যায় জাতীয় ইতিহাসের ‘মহত্তম অর্জন’ এবং যা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে নতুন জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রথম ঐতিহাসিক স্মারক স্তম্ভ। এমন এক বিশাল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এক পর্যায়ে থেমে যায়; তবে এর প্রভাব থেকে গেছে চিরদিন জাতির জীবনে। প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ এ সম্পর্কে বলছেন, ‘স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন স্বাভাবিক নিয়মেই গতিশীলতা হারাইয়া ফেলে। আন্দোলনে ভাটা দেখা দেয়। সাংগঠনিক শক্তির অভাবে এই ভাষা আন্দোলনকে বৈপ্লবিক কোনো আন্দোলনে রূপান্তরিত করা সম্ভব ছিল না। তদুপরি সরকারি তৎপরতা ও দমননীতির দরুণ আন্দোলনের অভ্যন্তরেও বিশ্বাসঘাতকতা মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে শুরু করিয়াছিল।’ [অলি আহাদ; জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫; বাতিঘর, ১৯৮২; পৃঃ ২২২]
আর এভাবেই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি বিপ্লবী রূপান্তরের যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারতো, তার ইতি ঘটলো। তবে এর প্রভাব চলে যায় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। আজও জাতিসত্তার ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনকে মূল স্তম্ভ বলেই মনে করতে হবে। সাথে সাথে এ-ও মনে রাখতে হবে—বিপ্লবের কখনোই মৃত্যু হয় না। আজ না হয় কাল।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মাধ্যমে যারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও এর আগে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের লক্ষ্যে মূল কাজটি করেছিলেন, সেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ হেরে যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনটি শাখা মুসলিম লীগের বিপুল পরাজয় ও বিকল্প শক্তির বিজয় স্বাধীন জন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের যে বিপ্লব, তার বীজ বপনের একটি মাইলফলক। এ লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত থাকে পরবর্তীকালে। ১৯৫৭ সালে মজলুম জননেতা ও যুক্তফ্রন্টের অন্যতম রূপকার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্পষ্টভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানকে জানিয়ে দেন—‘আসসালামু আলাইকুম’। আর এটাই স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে পৃথক জাতি রাষ্ট্রের প্রথম বিপ্লবী ধাপ এবং স্বপ্ন বুননের শুরু। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সহ-সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ গঠনও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। যা পরে ভেঙে যায়—মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতি সমর্থন ও বিরোধিতার কারণে। সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন নীতির প্রতি নীতিগত সম্মতি দেন এবং মওলানা ভাসানী ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’ গঠন করে সরকারের মার্কিন নীতির ঘোরতর বিরোধী হিসেবে রাজনৈতিক পথ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের বিভক্তির ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৭ সালে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক জটিল রূপ নেয়, যাতে সংবিধান প্রণয়নই প্রলম্বিত হয়। তবে সে পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম সংবিধানটি প্রণীত হয়। অর্থাৎ দেশভাগের ৯ বছর পরে। এতে এক কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ, ইসলামকে আদর্শ এবং উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করা হয়।
তবে সংবিধান আলোর মুখ দেখার সাথে সাথে ঘটে যায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় এবং গণতন্ত্রবিরোধী ১৯৫৮ সালের ‘সামরিক শাসন’। সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট এবং আশীর্বাদে কিন্তু মার্শাল আইউব খান ক্ষমতা দখল করেন। কমিউনিস্ট খেদাও বা হটাও—এটা বলা হয়। আর এটি ছিল এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে একটি বড় পদক্ষেপ। এই সামরিক শাসন তখন ‘একটি সামরিক আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বে, বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাততন্ত্রের’ সমন্বয়ে গঠিত সরকার। ১৯৫৬ সালের আলোর মুখ না দেখা সংবিধানে পাকিস্তান ছিল প্রেসিডেন্সিয়াল বা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। আর এটি সেনাশাসক আইউবকে অচিরেই প্রেসিডেন্ট হতে সহযোগিতা করেছিল। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের গণতন্ত্রের দীর্ঘকালীন নির্বাসনে যাবার জন্য ১৯৫৮ সালকে নিঃসন্দেহে চিহ্নিত করা যায়। এতে অভিজাততন্ত্র খুব সহজেই লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট পুঁজির ৬৬ শতাংশ (বিশেষত শিল্পপুঁজি) নিয়ন্ত্রণ করেছে মাত্র ২২টি পরিবার। কার্যত সামরিক শাসনের নামে সেনাশাসক আইউব খান একদিকে গণতন্ত্রপন্থি এবং মূলত বামপন্থিদের ওপর জেল-জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন। অন্যদিকে, জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ‘উন্নয়ন’ নামে ‘নয়া তত্ত্ব’ হাজির করেন। তিনি আসলে দেশে উন্নয়নের নামে জনসমর্থন লাভের চেষ্টা করছিলেন। আইউব খান তার রাজনৈতিক আত্মজীবনীতে নিজেই স্বীকার করেছিলেন “জনগণ ‘চটজলদি’ বা ‘ইমিডিয়েট” ফলাফল দেখতে চায়। আইউব খান বলেন, ‘Friends not Masters-People always want immidiate results’ [Friends not Masters, Oxford University Press, Karachi, 1967, Page-79]
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ফ্যাসিস্ট বা অত্যাচারী গণবিরোধী সরকারগুলো ‘উন্নয়ন’ নামের সহজ পথটিই বেছে নেয়। তবে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনো কাজ হয়নি। ক্ষমতাকে আইনসিদ্ধ করার জন্য তার বেসামরিক গণভিত্তির প্রয়োজন পড়ল। তিনি গঠন করলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ বা Basic Democracy। এর মাধ্যমে তিনি স্থানীয় গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি ও টাউটতন্ত্রের বিস্তার ঘটালেন, মূলত মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা ছিল রাজনীতি থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নির্বাসন দেয়া এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা। [বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমীর খসরু, সংকটে গণতন্ত্র: সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসনের সমস্যা; অনন্যা প্রকাশনী; ঢাকা-নভেম্বর ২০২৩, পৃ-১৩৫-১৪০]
এখানে বলা প্রয়োজন যে, আইউব খান সেনাশাসক হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন। এ কারণে তিনি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতন্ত্রী বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দেশগুলোর বিপক্ষে আমেরিকার Central Treaty organisation (CENTO), যা বাগদাদ চুক্তি নামে পরিচিত—তাতে সদস্য হওয়ার জন্য কথিত বেসামরিক সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেন এবং ১৯৫৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান এতে স্বাক্ষর ও সমর্থন ঘোষণা করে। কমিউনিস্ট হটাও ইস্যুতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আরেকটি সংস্থা—South East Asia Treaty organisation (SEATO) বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থায় পাকিস্তান যোগ দেয় এবং ১৯৫৪ সালের মে মাসে এতে স্বাক্ষর করে। এটা করা হয় পাকিস্তানে গড়ে উঠতে পারা ‘বিপ্লব বা বিপ্লবী’ সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে। এটি কেন এই ভূখণ্ডে বিপ্লবকে ‘হত্যা’ বা বিনষ্ট করা হয়—বারবার তার অন্যতম কারণ। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৬২ সালের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ। ১৯৬২ সালের ওই আন্দোলন বাম ধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ তখনো সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল ছিল। এই ছাত্র আন্দোলন ছাত্ররা পরিচালনা করলেও এর মধ্য দিয়ে—একদিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করে; তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী সম্ভাবনার বীজ বেশ ভালোভাবেই গজিয়ে উঠতে শুরু করে। এর পরে ছাত্রদের আন্দোলন চলতে থাকে। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৬৫ সালে। তা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে উভয় অংশ অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। বিশেষ করে দূরত্বের বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিকটিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করে।
এরই মাঝে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ছয় দফা, যা এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে। ছয় দফায় বলা হয়, ‘ভারতের সাথে সতেরো দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণে রেখে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে নতুন করে দেখা অত্যাবশ্যক। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শাসনকার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে বাস্তব যেসব অসুবিধা দেখা দিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রশ্নটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।... সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনায় পাকিস্তানে দুটি অংশ যাতে ভবিষ্যতে আরও সুসংহত করা যায়—সে লক্ষ্যেই এই সংক্ষিপ্ত ইশতেহারটির লক্ষ্য। ইশতেহারের প্রথম দফায় বলা হয়—পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র সংঘ—যার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। ১. সরকার হবে পার্লামেন্টারি ২. কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা কেবল দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে—যেমন দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয় এতে সন্নিবেশিত হয়।
দেশ ক্রমাগত স্বাধীন পূর্ব বাংলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাম সংগঠনগুলো বলতে থাকে ‘এর পথ বিপ্লবের’। যদিও আওয়ামী লীগ এর ঘোরতর বিরোধী ছিল। (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন