

মূলধারার গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গনের বহুমাত্রিক নেতিবাচক সংবাদ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আমাদের কাছে নিত্যকার ঘটনা! এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক খবর যে একেবারেই থাকে না কিংবা ঘটে না, তা নয়। কিন্তু নেতির প্রতাপে ইতির খবরগুলো চাপা পড়ে যায়। এরকম অনেক কাজই হয়তো আমাদের সমাজে থাকে, তা আমাদের চোখে পড়ে না। যখন এসব কাজের বড় কোনো স্বীকৃতি মেলে, তখনই তা দৃষ্টিগোচর হয় এবং সেসব কাজের সমাদর বাড়ে। এমন একটি খবর যেমন চলনবিলের সৌরশক্তিচালিত ভাসমান স্কুলের ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ কনফুসিয়াস সাক্ষরতা পুরস্কার-২০২৫ অর্জন। এটি একটি ইতিবাচক খবর, যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক ও উৎসাহব্যঞ্জক।
চলনবিল এলাকায় শৈশব থেকে বড় হওয়া মোহাম্মদ রেজোয়ান সিধুলাই ভাসমান স্কুলটির স্থপতি। প্রতি বছর বন্যায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০২ সালে উদ্ভাবন করেন এই অনন্য সমাধান। স্থানীয় নৌকাকে রূপান্তরিত করা হয় ভাসমান স্কুলে। এটি বিশ্বের প্রথম ভাসমান স্কুল হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে এসব সৌরচালিত নৌকা শুধু স্কুল নয়, লাইব্রেরি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে, যা বর্ষায় পানিবেষ্টিত গ্রামগুলোয় সারা বছর শিক্ষার সুযোগ বজায় রাখছে।
শিক্ষায় উদ্ভাবন ও জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রসারে এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান। এ বছর বিশ্বজুড়ে শত শত মনোনয়নের মধ্য থেকে ইউনেসকো বিজয়ী হিসেবে নির্বাচন করে তিনটি উদ্যোগকে—বাংলাদেশের সিধুলাই ভাসমান স্কুল, আয়ারল্যান্ডের লার্ন উইথ নালা ই-লার্নিং এবং মরক্কোর সেকেন্ড চান্স স্কুল অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন প্রোগ্রাম। ইউনেসকো এ উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছে, বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত উপায়ে সাক্ষরতা শিক্ষা পৌঁছে দেওয়াই ভাসমান স্কুলটির সাফল্য। ভাসমান স্কুলটির মডেল এখন দেশ-বিদেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে রেজোয়ানের ভাসমান স্কুলকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০৫০-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এর আগে রাজশাহীর পলান সরকারের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণের মতো মহতী কাজের কথা সবার জানা। ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’ পলান সরকার জীবনভর নিজের টাকায় বই কিনে গ্রামের মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। এজন্য ২০১১ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি এবং পরিচিতি পান ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হিসেবে। এ ছাড়া পাখির বাসস্থানের জন্য বছরের পর বছর ধরে শত শত তালগাছ রোপণ করে তাক লাগিয়ে দেন গফরগাঁওয়ের রফিকুল ইসলাম। তালগাছ কমে যাওয়ায় বাবুই পাখির বাসস্থান রক্ষায় এ উদ্যোগ নেন। গাছ রোপণের পাশাপাশি সেই গাছ থেকে রস সংগ্রহ করাও বন্ধ রাখেন, যেন পাখিরা নিরাপদে থাকতে পারে। এমন অনেক আশাব্যঞ্জক কিংবা মন ভালো করার মতো কাজও আমাদের সমাজেই হয়। অনেকে তা করেন নীরবে-নিভৃতে-নিঃস্বার্থভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব কর্ম প্রতিনিয়ত দেখা অসংখ্য নেতিবাচক কাজের মধ্যেও আমাদের আশান্বিত করে, বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয় এবং অন্যদের উৎসাহিত করে একটি সুন্দর দেশ তথা সমাজ গড়ার কাজে, যেখানে মানুষ পশু-পাখি প্রকৃতি পরিবেশের এক ঐকান্তিক সমারোহ বিরাজ করবে; গড়ে উঠবে সব প্রাণ ও প্রকৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমরা চলনবিলের সিধুলাই ভাসমান স্কুলের এ অর্জনকে সাধুবাদ জানাই।
মন্তব্য করুন