

[দ্বাদশ পর্ব]
এদের অধিকাংশকেই কথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ভুয়া অভিযোগে হত্যা করা হয়। ২০২৪-এর আগস্টের পর বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে জঙ্গিবাদ, দক্ষিণপন্থা এসব গায়েব হয়ে যায়। ভুয়া এবং মিথ্যা বয়ান প্রচার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বয়ান ছড়াতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ বা দক্ষতা, প্রজ্ঞার অভাব অথবা কোনো কূটকৌশলের অংশ—সে প্রশ্ন করার সময় এসেছে।
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য নেই, ঐক্য নেই; জুলাই সনদ প্রণয়নে এমনকি কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে সে সম্পর্কেও কোনো ঐকমত্য নেই। এক জটিল এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে দেশ। যে ড. ইউনূস বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এবং বক্তব্যে ‘তার সময়ের যে জাতীয় নির্বাচন হবে, তা হবে ঐতিহাসিক, যা এ দেশে আর কখনোই হয়নি’ বলেছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, সংস্কারসহ গণতান্ত্রিক কাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া নির্বাচন দেওয়ার কোনো মানে নেই। সেই ড. ইউনূস এখন তড়িঘড়ি করে, তাড়াহুড়া করে একটি নির্বাচন দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বিদায় নিতে চান—যেখানে সংস্কারের কোনো সুরাহা নেই, জুলাই সনদের কোনো হদিস নেই, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রয়ে গেছে এক বিরাট মতপার্থক্য। চরম সংকট। চারদিকে নির্বাচন হবে কি হবে না—এ নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন, জল্পনা-কল্পনা। এর মধ্যে পুরো পরিস্থিতিতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ‘ড. ইউনূস’ একবার পদত্যাগ করার হুমকিও দেন।
প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস ১৪ আগস্ট ২০২৫ ‘A year after the revolution, Bangladesh, hope turns to Frastation in Bangladesh’ শীর্ষক এক দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ধীরগতিতে অনেক বাংলাদেশি হতাশ। তারা ভাবছেন, তবে কি আবু সাঈদের মতো বিক্ষোভকারীরা বৃথাই নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, চাকরিস্বল্পতা ও প্রবলভাবে জেঁকে বসা প্রশাসনের আমূল পরিবর্তনের পদ্ধতিগুলোর সমস্যা দূর করার চেষ্টা করছে। আর এসব সমস্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনরোষে বাড়িয়ে দিয়েছিল।’
দেশ-বিদেশে চলেছে বিস্তর আলাপ-আলোচনা এসব নিয়ে। অথচ ২০২৪ সালেই শ্রীলঙ্কায় যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, যাতে তাদের প্রেসিডেন্টসহ অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং তাদের প্রবল দেশপ্রেম, দক্ষতা-প্রজ্ঞা এক নতুন শ্রীলঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সেই দেশটিতে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে আর এসবই ঘটেছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঐক্য, দেশপ্রেম ও প্রজ্ঞার কারণে।
কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক দলের এবং নেতৃত্বের পারস্পরিক কামড়াকামড়ি ও বিবাদের কারণে এখন ভিন্ন পরিস্থিতি।
এ সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক প্রতিবেদনে বলেছে, “ক্ষমতাপ্রত্যাশী বড় দলগুলোর শর্তসাপেক্ষ ঐকমত্য সংস্কার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সাংবিধানিক এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা ও সুনির্দিষ্ট পথরেখা অমীমাংসিত থাকায় সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণকে ঝুঁকির সম্মুখীন করেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি—দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান; যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কারের মূল চেতনা ধারণ, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ...দলীয়করণের ধারা অব্যাহত রেখে ... কর্তৃত্ববাদের মেয়াদে যারা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের বাইরে ছিলেন তারা মূলত দলীয়করণ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দলীয়করণের ধারা অব্যাহত রেখে ‘এবার আমাদের পালা’—এই সংস্কৃতি চর্চায় লিপ্ত হয়েছেন।” [টিআইবি গবেষণাপত্র, ৪ আগস্ট, ২০২৫]
এক জটিল ও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে এমন ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর ২৮ আগস্ট ২০২৫ ঘোষণা করা হয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা—যাতে নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার কথাও জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের রোডম্যাপকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী বলছে, ‘এই রোডম্যাপ ঘোষণা অপরিপক্ব ও আংশিক।’ এনসিপি বলছে, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচনের দিকে যাওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল।’ এখানেও দ্বিমত। আর বাতাসে নানা গুঞ্জন। গুঞ্জন প্রতিবিপ্লবের।
তাহলে সংস্কারের, জুলাই সনদের, রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো বদলের যে ইতি ঘটল তা নিশ্চিত। এখানে বলে নেওয়া ভালো, ‘নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান’—উত্তর-উপনিবেশবাদের ভাবশিষ্য তারা ভাবছেন ভিন্নভাবে যারা ‘এখনো মনস্তাত্ত্বিক ভাবে’ উপনিবেশবাদের ‘মন মানসিকতায় আচ্ছন্ন ও ওই মনস্তত্ত্বের লালনপালনকারী তারা পরিবর্তনবিরোধী’ এবং শুধু শাসক বদলেই আগ্রহী—তাদের কূটকৌশল বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশকে যারা নয়া উপনিবেশবাদী ও সম্প্রসারণবাদের রাষ্ট্র বানাতে চায় সেই ‘চিহ্নিত’ শত্রুর কর্মপরিকল্পনা বিজয়ী হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিশেষ করে একটি দেশের কর্মপরিকল্পনা তারা বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ী হয়েছে শুধু শাসক বদলেই সব সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব। বিজয়ী হয়েছে এলিট শ্রেণি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ীরাসহ বিশেষ সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বা ‘অলিগার্কি’। বিজয় হয়েছে ‘ডিপ স্টেটের’। বিজয়ী হয়েছে ফ্যাসিবাদে পরিণত হওয়ার সফল কাঠামো। আর যারা পরাজিত হয়েছেন এবং অতীতেও বারবার হয়েছেন—সেই সর্বস্তরের মানুষ অর্থাৎ সাধারণ জনগণ। তারাই বারবার রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য জীবন দেয় এবং সন্তানহারা, স্বজনহারা হয়, হতেই থাকে বারবার। বলা হয়ে থাকে আন্দোলন, সংগ্রাম, পরিবর্তনে, বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায়— সাধারণ মানুষ সন্তানকে ‘শহীদ’ হওয়ার জন্য পাঠায়। আর সমাজ ও রাষ্ট্রের উপরিতলার মানুষগুলো—ওই শহীদদের জন্য পাঠায় শুধু নামকাওয়াস্তে ‘সমবেদনপত্র’। যেমন, জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকীতে ঘোষণা করা হলো, ‘যারা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, বিকলাঙ্গ হয়েছেন, জীবনবাজি রেখে ফ্যাসিস্ট হটাও-উৎখাত আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন—তারা ‘জাতীয় বীর’। ব্যস, নিট প্রাপ্তি শুধু এ পর্যন্তই। ওই ঘোষণার কোনো আইনি ভিত্তি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। কেন থাকবে?
কেন যেন ‘আরব বসন্ত’র মতো এক ব্যর্থ ‘গণবিপ্লবের’ আলামত খুঁজে পাই। আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে তিউনেসিয়ায় এবং যা ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ বিপ্লবটি হয় স্বৈরতন্ত্র উৎখাত, দুর্নীতি, গণদারিদ্র্য দূর করা, সত্যিকারের গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার, কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। আর ২০১০-এর ১৮ ডিসেম্বর মোহাম্মদ বোয়াজিজি গায়ে আগুন দিয়ে এ আন্দোলনের সূচনা করেছেন। বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেয়। আর স্বল্পকালেই তা পর্যবসিত হয় এক ‘ব্যর্থ বিপ্লবে’।
বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবকেও বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে নির্মমভাবে ‘হত্যা’ করেছে ও ব্যর্থ করেছে। হত্যা করেছে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো বদলে ১৯৭১-এর পরবর্তীকালের ৫৪ বছরের অপূর্ণতার পূর্ণতা বাস্তবায়নের স্বপ্নকে। এত একক আবু সাঈদ, মুগ্ধর মতো মাত্র কয়েকজনের শহীদ হওয়া নয়। কমপক্ষে দুই হাজার শহীদ, হাজারে হাজারে আহত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা এবং স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষায় আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হওয়া অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশার স্বপ্নকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। বিনষ্ট করা হয়েছে স্রেফ কূটচালে, নিজেদের স্বার্থে। আর আবারও প্রমাণিত হয়েছে ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব’ নতুন প্রজন্ম বা জেনারেশন যাদের Gen-Z বা জেনারেশন জেড বলা হয় তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়াকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতের মতো প্রমাণিত হয়েছে ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্বই, যারা বারবার বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যায় এবং যাচ্ছে। জুলাই বিপ্লব তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। কারণ সত্যিকারের ইতিহাস তা আজ হোক বা আগামীতে হোক, সত্যকে উন্মোচিত করবেই। এখনকার ‘জেন-জেড’ এবং ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্ম ‘নতুন এক বাংলাদেশের’ স্বপ্ন লালন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আবার হয়তো নতুন কোনো আবু সাঈদরা, মুগ্ধরা জেগে উঠবে—আরও কঠিন কোনো স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। ‘কারণ বিপ্লবের বা এর আকাঙ্ক্ষার কোনো দিনই মৃত্যু নেই’। এর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা কখনোই শেষ হয় না, যদিও নানা কূটকৌশলে সাময়িকভাবে ব্যর্থ করা যায়, দমন করা যায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশ কখনোই ব্যর্থ হবে না। ‘নতুন এক বাংলাদেশ’, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ জেগে উঠবেই। হতাশা কোনোদিন স্থায়ী হয় না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই। স্বপ্ন আসলে উদ্দীপনার অপর নাম।
আর এত দীর্ঘ আলোচনায় নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয়েছে যে, বিপ্লব এবং এর আকাঙ্ক্ষাকে কীভাবে, কারা ব্যর্থ করে দিয়েছে বারবার। আবারও বলতে হয়—ইতিহাস বহতা নদীর মতো। মানুষের দৃঢ় কঠিন স্বপ্ন এক ভিন্ন আঙ্গিকের আদলের আকাঙ্ক্ষার বিজয় অনিবার্য। সাধারণ মানুষ আবারও জেগে উঠবে। কিন্তু কবে এবং কখন তারই অপেক্ষায়। [শেষ]
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন