

মো. সাইদুর রহমান (ছদ্মনাম), পড়াশোনা করছেন একটি স্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে। হলে সিট না পাওয়ায়, থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি মেসে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তার পড়াশোনা, খাওয়া, থাকাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা তেমন সুখকর নয়। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর কোনোই অবস্থা নেই। তার অধ্যয়নের বিষয়, বর্তমান বাজার চাহিদার বিচারে কিছুটা নিচের দিকের হওয়ায়, কোনো টিউশনিও পাচ্ছেন না। একটি জেলা শহরে এমনিতেই টিউশনির জোগান চাহিদার তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল। আর্থিক সংকট, টিউশনি নেই, সামনে সেমিস্টার চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা। এভাবে দিনে দিনে তার মানসিক চাপ হিমালয় পর্বতের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছেন না। সাইদুরের মতো এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এ দেশের হাজারো উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের। সাইদুর রহমান একটা উদাহরণ মাত্র।
ইউজিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ২০২৩ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫৩টি (আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন হয়েছে পরে)। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৮ লাখ ২১ হাজার ১৬৫ জন। দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৪ জন।
উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সমস্যায় পড়তে হয় অনেককেই। নিজের পছন্দমতো বিষয় না পাওয়া ও হলের পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টি, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং মন খুলে কথা বলতে না পারার কারণেও হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন অনেক শিক্ষার্থী।
এ দেশে বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা পড়াশোনা করেন। মানুষের সাধারণত পাঁচটি মৌলিক চাহিদা—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। একটি জাতিকে অগ্রগতি ও উন্নতির পথে নিতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন করতে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালীন এবং গ্রহণ সমাপ্তে একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা, ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা, পারিবারিক চাপ, রেজাল্ট আশানুরূপ নিয়ে চাপ, সেশনজট সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, সম্পর্কের চাপসহ এমন নানাবিধ মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুল আওয়াল সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, ‘একটি শিশুর জন্মের মধ্য দিয়েই চাপের সৃষ্টি হয়।’ হ্যাঁ, তার কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ বিরাজমান। এ চাপ কখনোই শেষ বা একেবারে নির্মূল করা যায় না। তবে চাপ কমানো সম্ভব। সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে তুলনামূলক চাপ বেশি থাকে; কারণ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তারা দায়িত্বশীল থাকেন এবং ভাবনায় রাখেন।
মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য যা করা যেতে পারে; পৃথিবী রকেট গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, এর সঙ্গে মানুষও দৌড়াচ্ছে। জগতের নানাবিধ নেতিবাচক চিন্তায় মানুষ ডুবে যাচ্ছে। এসব নেতিবাচক চিন্তা দূর করে ইতিবাচক ভাবনা বাড়াতে হবে। শরীর ও মন একটি অন্যটির সঙ্গে মিশে আছে; এর যত্ন নিতে হবে। জীবন একটাই; একে জটিল না করে, সহজ করে দেখতে হবে। অন্তর্মুখী না থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব প্রকাশ করতে হবে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো ‘নো দাইসেলফ’ মানে ‘নিজেকে জানো’। তেমনি নিজের জীবনকে নিজে ভালোবাসতে হবে। মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের রাতে সাত-নয় ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। তবে কেউ কেউ নিয়মিত ছয় ঘণ্টা ঘুমেও ভালো থাকতে পারেন। ঘুমের কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে ল্যাপটপ, মোবাইল, টিভি দেখা বন্ধ করা এবং রাতের খাবার শেষ করতে হবে।
স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নযোগ্য এমন স্বপ্ন দেখতে হবে। নতুন চিন্তাকে গ্রহণ করা এবং ইতিবাচক বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। সামাজিকতা বজায় রাখা, ব্যায়াম করা এবং পরিমাণমতো বিশ্রাম নিতে হবে। রাগ হলো মানুষের স্বাভাবিক আবেগ। রাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রিয়জন এবং নির্ভরযোগ্য কারও সাহায্য নিতে হবে। মনের প্রশান্তি বাড়ানো, সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। সংকটে ভেঙে পড়লে চলবে না। ‘অস্থির সময়ে স্থির থাকা’—এ সূত্র প্রয়োগ করা এবং পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, ইতিবাচক, বিশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা এমন মানুষদের বন্ধুর তালিকায় রাখুন; যারা আপনাকে হতাশ করবে না, উৎসাহ দেবে।
মুখে এক কথা এবং অন্তরে অন্য কিছু; এমন মানুষ থেকে দূরে থাকুন। পরশ্রীকাতর (অন্যের উন্নতিতে কাতর) এবং নেতিবাচক মানসিকতার মানুষদের বর্জন করুন। সেইসঙ্গে নিজেও কারও সাফল্য দেখলে মন খারাপ করা; এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের ব্যবহারযোগ্য জিনিস ঘুছিয়ে রাখা এবং অন্যের সমালোচনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিন, যে আপনাকে সৃষ্টির সেরা জীব করে পাঠিয়েছেন। সেইসঙ্গে নিজেকেও ধন্যবাদ দিন, নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন, নিজেকে কখনোই তুচ্ছ ভাবা যাবে না। নেশা থেকে বিরত থাকুন। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং সময়ের কাজ সময়েই শেষ করতে হবে। নিজেকে পর্যাপ্ত সময় দিন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গুণগত সময় অতিবাহিত করুন। প্রচলিত নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। জীবনে ব্যর্থতা আসবে; ধৈর্যধারণ করে কাজের মাধ্যমে ব্যর্থতা পেছনে ফেলে সফলতা অর্জন করতে হবে।
আসলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণই একটা চাপ। চাপকে আমাদের ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট) করতে হবে। যতদিন প্রাণ থাকবে, ততদিন চাপ থাকবে। কাজের ধরন যাই হোক না কেন; মানুষ যদি তার কাজকে সততা, স্বচ্ছতা এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করে, তাহলে অবশ্যই ব্যক্তিজীবনে সফলতা এবং মানসিক দুশ্চিন্তা ব্যাপকভাবে কমে আসবে।
লেখক: উপপরিচালক (জনসংযোগ), পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন