মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:২৪ এএম
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:০১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডালমে কুচ কালা হ্যায়

ডালমে কুচ কালা হ্যায়

মাত্র দুই মাস আগেও বিশ্বব্যাপী একটি সন্দেহ ছিল, পাকিস্তানে আদৌ নির্বাচন হবে কি না। দিনশেষে পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছে, ৮ ফেব্রুয়ারি। এদিক দিয়ে খবরটি ইতিবাচক। ১২ ফেব্রুয়ারি (গতকাল) এ লেখা যখন লিখছি তখন পাকিস্তানে পিপিপি এবং পিএমএল-এন একটি সমঝোতায় এসেছে। আজ ঘোষণা আসতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনগণের একটি বড় অংশ অসন্তোষের সঙ্গে প্রতিবাদে নেমেছে। তেহরিক-ই-লাব্বাইকের মতো গোড়া দল আবার মাঠে নেমে আসার হুমকি দিয়েছে। এই দলটির কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা অনেকটা আমাদের দেশের হেফাজতে ইসলামের মতো। পাকিস্তানের জনগণের একটি বিশাল অংশ মনে করছে, ভোট নিয়ে চোরাকারবারি হয়েছে। কারণ ৭২ ঘণ্টা সময় লেগে গেছে নির্বাচনের পূর্ণ ফল ঘোষণা করতে। নির্বাচনের দিন ইন্টারনেট সেবা এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তার পেছনেও এ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার বিষয় ছিল বলে অনেক ইমরান সমর্থকরা মনে করে। যুক্তি আছে বটে!

সংবাদ হিসেবে সবার জানা থাকলেও আরও একবার ফল উল্লেখ করা প্রয়োজন। পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির ২৬৬ আসনের মধ্যে ২৬৫টিতে নির্বাচন হয়েছে। ফলাফলে সর্বাধিক সংখ্যক ১০২টি আসন পেয়েছে কারাবন্দি ইমরান খানের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অবশ্য সব স্বতন্ত্রই ইমরান খানের দলের নয়। অন্তত ৯টি আসন থেকে সত্যিকার স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছে। তবু তর্কের খাতিরে ধরে নিতে হবে তারাও হয়তো পিটিআইকেই সমর্থন দেবে। অন্যদিকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) বা পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি পেয়েছে যথাক্রমে ৭৯ ও ৫৪টি আসন। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইমরান খান কারাগার থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহার করে তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা জয়ী হয়েছি ১৭০টি আসনে। ১৭০টি আসন মানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ওদিকে নওয়াজ শরিফও জনগণের উদ্দেশে বিজয় ভাষণ দেন। তবে কৌশলগতভাবে নওয়াজ শরিফের দাবি সঠিক। কারণ, দল হিসেবে পিএমএল-এন সর্বাধিক আসন পেয়েছে। ইমরানের প্রার্থীরা তো স্বতন্ত্র! পাকিস্তানের নিয়মানুসারে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য তিনটি পথ খোলা থাকে। তারা নিজেরা একটি জোট করতে পারেন, অন্য যে কোনো একটি দলের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, অথবা একেবারে একা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে থাকতে পারেন।

পাকিস্তানে এখন কয়টি সত্তা (এনটিটি) কাজ করছে? এক অর্থে দুটি—ইমরানের পিটিআই এবং পিটিআইবিরোধী। আবার অন্যভাবে বিবেচনা করলে পাকিস্তানে এখন চারটি আলাদা সত্তা রয়েছে। রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন। আগে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় থাকা না থাকা নির্ভর করত সেনাবাহিনীর ওপর। সরকার পছন্দ না হলে তারা সোজা বন্দুক নিয়ে ঢুকে বসে পড়ত ক্ষমতার মসনদে। এখন আদালত ও প্রশাসন ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেই অর্থে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খানিকটা খর্ব হয়েছে বলা যায়। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায় ওঠানো-বসানোর মিউজিক্যাল চেয়ার অব্যাহত আছে। ২০১৭ সালে নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে পানামা পেপার্সের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ইমরান খানকে ২০১৮ সালে ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়। আবার এই ইমরান খানকেই কয়েকটি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করে ‘সাংবিধানিক’ উপায়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করা হয় ২০২৩ সালে। এখন তিনি কয়েকটি মামলায় দোষী হয়ে কারাগারে আছেন (আবার কখনো আপস হলে ফুলের মালা গলায় দিয়ে বের হয়ে আসবেন)। এ পরিস্থিতির কারণ বলতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হয়।

খান বরাবরই সেনাবাহিনী এবং দেশটির মৌলবাদী ঘরানার সঙ্গে সখ্য রেখে চলেছেন। তিনি প্রথম রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করেছিলেন পাকিস্তানের জামায়াত-ই-পেসবান দলে যোগদানের মাধ্যমে। এই দলটি ছিল জামায়াত-ই-ইসলাম পাকিস্তানের একটি শাখা। ইমরান যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের কট্টরপন্থি আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুলের হাত ধরে। পরে তিনি ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই গঠন করেন। তখনো ইমরান সেনাবাহিনীরই লোক। ইমরান খানের জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গেও যেমন সখ্য ছিল, তেমনি জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সঙ্গেও। পাকিস্তানের রাজনীতিতে খানের দল একেবারেই সাদামাটা ছিল। ১৯৯৭ সালে নির্বাচনে দুটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি একটিতেও জিততে পারেননি। খান তখন পারভেজ মোশাররফের একজন তাঁবেদার। ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফের আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা নিয়ে গণভোট হয়। সে গণভোটে ৯৭.৯৭ ভাগ পাকিস্তানি নাকি মোশাররফ ক্ষমতায় থাকার পক্ষে সায় দেয়! ইমরান সেই গণভোটকে সমর্থন করেছিলেন। পারভেজ মোশাররফের অধীনে ২০০২ সালে নির্বাচন করে তিনি তার আসন মিয়ানাওয়ালি থেকে ‘জয়’ পেয়েছিলেন। কিন্তু খান পরে সময়মতো মোশাররফের পেছন থেকে সরে যান।

যেহেতু পাকিস্তানের জনগণের বিশাল অংশ অত্যন্ত ধর্মপ্রবণ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী, তাই দিনে দিনে ইমরান এমন কিছু ইস্যুতে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন যে, তিনি পাকিস্তানি রাজনীতিতে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতিবাদ করেন এবং জ্বালাময়ী ভাষণ ও বিবৃতি দেন। অবশেষে ২০১৮ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী ‘নির্বাচিত’ হন। তার সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়ার ছিল অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক। তিনি কমর বাজওয়ার চাকরির সম্প্রসারণের পক্ষে ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কারণে দুজনের মধ্যে চরম বৈরিতা দেখা দেয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধানকে নিয়োগ এবং হুসেন হাক্কানিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা নিয়ে মনোমালিন্য চরমে ওঠে। এতটাই চরমে যে, বাজওয়া ইমরান খানকে প্রকাশ্যে মুখের ওপর প্লেবয় বলে গালি দেন। এ কথা ইমরান স্বীকারও করেছেন। এই কমর বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ শিষ্য বর্তমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অসিম মুনির এবং সত্যি কথা বলতে কি, তিনি ইমরানের প্রতি বাজওয়ার চেয়েও অধিক ক্রুদ্ধ। অসিম মুনির নির্বাচনের পর বলেছেন, পাকিস্তানের জন্য একজন স্থিতিশীল ব্যক্তি প্রয়োজন। কথার কিছু সত্যতা আছে। নওয়াজ শরিফ অনেক অভিজ্ঞ এবং স্থির মানসিকতার।

এ ক্ষেত্রে নওয়াজ শরিফকেই প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারেন, বিলাওয়াল ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ নন। কারণ কিছুকাল আগেই তাকে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে এনে দুর্নীতির মামলাগুলোতে অব্যাহতি দিয়ে রাজনীতিতে নামানো হয়। তিনিও আদালতের মাধ্যমে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন রাজনীতিতে। এদিকে ইমরান খান এরই মধ্যে পাঞ্জাবে, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং কেন্দ্রে তার সমর্থক ও স্বতন্ত্র বিজয়ীদের আন্দোলন করার জন্য ডাক দিয়েছেন। সুতরাং সবকিছু মিলে পাকিস্তান সহসা শান্ত হবে বলে মনে হয় না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তানে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তার প্রতি সমর্থন আরও বেড়েছে। তাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিতে তারই দল থেকে বের হয়ে এসে তেহরিক-ই-পাকিস্তান পার্লামেন্ট দল গঠন করেছিলেন পারভেজ খাত্তাক। তিনি এবং তার পুত্ররা ইমরানের সমর্থকদের কাছে ব্যাপক ব্যবধানে হেরেছেন। ইমরানকে হটিয়ে দেওয়ার সময় গঠিত আরেক দল ইশতেকাম-ই-পাকিস্তান পার্টির প্রধান জাহাঙ্গীর তারিনও প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে মুলতান থেকে ইমরানের সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। সুতরাং সবকিছু সহজভাবে হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের একটি ইতিবাচক দিক হলো, এ নির্বাচনের ভাগ্য প্রায় নির্ধারিত ভেবেও পাকিস্তানের ৪৭ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। বিশেষ করে পিটিআই সমর্থকরা ঘরে বসে থাকেননি। তবে পিটিআই বা স্বতন্ত্র নির্বাচিতরা পার্লামেন্টে যাবেন। তারা সংরক্ষিত আসনের বড় অংশীদার। সুতরাং একটি পার্লামেন্ট চালু হতে যাচ্ছে।

পাকিস্তানে নির্বাচন-উত্তর একটি সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন সঙ্গীন। জ্বালানি নেই, খাদ্য নেই, ফরেন রিজার্ভ তলানিতে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আগের সহায়তা নেই—এমন পরিস্থিতিতে দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সুদূরপরাহত হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটেছে। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। সীমান্তে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু পাকিস্তানি সামরিক সদস্য নিহত হয়েছে। এমন অবস্থায় নওয়াজ শরিফ, শাহবাজ শরিফ, বিলাওয়াল ভুট্টো যেই হোন না কেন, পারবেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে?

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রভাবশালী প্রার্থীর পছন্দের প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগের অভিযোগ

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

জুমার দিন যেসব আমল করবেন

নির্বাচনী শোডাউনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যুবকের মৃত্যু 

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ

১ মণ ধানের দামেও মিলছে না দিনমজুর 

বাংলাদেশে আসছেন কুরুলুস উসমানের নায়ক বুরাক

সিলেটে ফের বিরতি ফিলিং স্টেশনে আগুন

এক হাজার সফল সার্জারি সম্পন্ন করেছে ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল

আলুর হিমাগারে মিলল লাখ লাখ ডিম

১০

শিক্ষার্থীদের বাস নিয়ে প্রোগ্রামে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ

১১

মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

১২

যুদ্ধ শেষে গাজায় যে পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র

১৩

দেড় শতাধিক লোকসহ টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ

১৪

স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে নাদিমের বাড়ি ৪৩ বছরের নারীর অনশন

১৫

‘পিডাইয়া লম্বা করে দেন, বহু উপরের নির্দেশ’

১৬

পাকিস্তানের হাতে অত্যাধুনিক রকেট, আতঙ্কে শত্রুদেশগুলো

১৭

আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ১৭ মে

১৮

মহাসড়কে হঠাৎ গুলি, নারী আহত

১৯

‘চট্টগ্রাম বন্দর একদিন পৃথিবীর অন্য দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে’

২০
X