সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মিয়ানমারে যেই জিতুক বিজয় চীনেরই

মিয়ানমারে যেই জিতুক বিজয় চীনেরই

গত বছর অক্টোবরের শেষ দিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতিগত তিনটি সশস্ত্র সংগঠন (এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন বা ইএও) দেশটির উত্তরাঞ্চলে বড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে সফলতা পাওয়ার পর পরই অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও মিলিশিয়া গোষ্ঠী মিয়ানমারের পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে জোরদার লড়াই শুরু করে। একের পর এক এলাকা আর স্থাপনা হারিয়ে চরম বেকায়দায় আছে জান্তা সরকার। অনেককে বিস্মিত করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী (তাতমাদো) একের পর এক বড় পরাজয়ের মুখে পড়েছে।

শান রাজ্যের সংখ্যালঘু তিনটি বাহিনী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) একত্রিত হয়ে ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’ গঠন করে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। তারা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট মিন্ট সুই বলেছেন, বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে না পারলে মিয়ানমার টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং সে জন্য জনগণের সমর্থন চান তিনি সেনাবাহিনীর জন্য। অবশ্য সেনাবাহিনী ভালো করেই জানে যে, তাদের প্রতি জনগণের সামান্য সহানুভূতিও নেই।

‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’-এর যৌথ অভিযানে টালমাটাল আড়াই বছরের সামরিক জান্তা সরকার বিদ্রোহীদের কাছে মার খেয়ে বিমান হামলা করছে বেসামরিক মানুষদের ওপর। এই সময়ের মধ্যে সাত লাখের মতো মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে, নিহত হয়েছে হাজার হাজার এবং সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে আরও লাখ খানেক মানুষকে। মিয়ানমার-চীন সংযোগ রক্ষাকারী সড়ক এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে বলে তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোট দাবি করেছে।

সেনা ছাউনি ও স্থাপনা ছেড়ে সেনারা পালিয়ে যাওয়ায় ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন বিদ্রোহীদের দখলে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। বলা হচ্ছে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর মিয়ানমারের কোনো কেন্দ্রীয় সরকার এত বড় প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। সে কারণেই ধারণা করা হচ্ছে যে, মিয়ানমারে সরকার পতন ঘটতে পারে যে কোনো সময়।

খবর এসেছে যে, বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে দেশটির বিদ্রোহীরা। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধে হারছে জান্তার সেনাবাহিনী। গত রোববার রাতে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, জান্তার বাহিনী একের পর এক, সেনা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছোট ও বড় ক্যাম্পের সেনারা বিদ্রোহীদের কাছে খুব দ্রুতই আত্মসমর্পণ করবে বলে ওই বিবৃতিতে দাবি করেছে অ্যালায়েন্সটি। সেইসঙ্গে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স আরও জানিয়েছে, যেসব ক্যাম্পের সেনারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি; তাদের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির (এএ) যোদ্ধারা হামলা অব্যাহত রেখেছে। তবে জান্তা বাহিনীও প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন পয়েন্টে আরাকান আর্মিদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

মিয়ানমার থেকে খবর আসে কম। কারণ কড়া সেন্সর। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরাও ঢুকতে পারছেন না। কিন্তু তবুও খবর আসে। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, অনেক এলাকায় ব্যারাক থেকে বের হলে মিয়ানমার সেনারা আক্রমণের মুখে পড়ছে। স্থলে যুদ্ধে প্রায় পরাজিত মিয়ানমার বাহিনী এখন নিজ দেশের বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে নির্ভর করছে বিমান হামলার ওপর।

সামরিক শাসকের বৈধতা নির্ভর করছে দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার ওপর। ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী প্রণীত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, মিয়ানমার অখণ্ড থাকবে এবং সেটা রক্ষা করবে দেশের সেনাবাহিনী। ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের যৌক্তিকতাও ছিল দেশের অখণ্ডতা, কারণ ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত যে বেসামরিক সরকার ছিল, সেটা তারা রক্ষা করতে পারছিল না। পরিস্থিতি এখন আবার সেদিকে গেছে। শহরের কেন্দ্রস্থল আর কিছু সামরিক ব্যারাক ছাড়া কিছুই সেনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।

শান প্রদেশ প্রায় পুরোটাই হাতছাড়া এখন। তিন বিদ্রোহী গ্রুপের সমন্বিত আক্রমণে দিশেহারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ৯৯তম লাইট ইনফেন্ট্র্রি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মারা গেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগ আছে যে, এই ইউনিট রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালানো, হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। লড়াইয়ে লিপ্ত তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার যার লক্ষ্য মিয়ানমারের মসনদ থেকে সেনা সরকারকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা।

২০২০ সালে নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছিল গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সাং সু চির দল। কিন্তু তার কিছুদিন পরই সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সু চি। সে বছর ১ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন সু চি ও অসংখ্য নেতানেত্রী। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে বহু আন্দোলন হলেও সেগুলো কঠোরভাবে দমন করে জান্তা সরকার। এবার সশস্ত্র আন্দোলনে পশ্চাদপসরণ করতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে।

‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ সদস্যরা উচ্চাভিলাষী এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। তাই চীনের ইঙ্গিত ছাড়া চীনের সীমান্ত ঘেঁষে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। জান্তা সরকারের একাধিক কার্যকলাপে চীন অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে শান প্রদেশে মাদক চোরাচালান রুখতে পারেনি মিয়ানমার সরকার এবং সে জন্যই এবারের এই পরিণতি।

মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর থেকে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিতে চীন নতুন নতুন সব কৌশল নিচ্ছে। চীনের নেতৃত্ব মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন গভীরভাবে। জান্তা সরকারকে কতটুকু সমর্থন দেওয়া যাবে আর কতটুকু যাবে না—সে হিসেব করা হচ্ছে সবসময়। মিয়ানমারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও বাড়ছে। চীনকে পেছনে ফেলে রাশিয়া এখন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার ৪০৬ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে বিমানের জ্বালানি নেওয়ার বিনিময়ে মিয়ানমার রাশিয়াকে অর্থ এবং বঙ্গোপসাগরের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। রাশিয়াকে এ অঞ্চলে তারা প্রাসঙ্গিক হওয়ার সুযোগও করে দিয়েছে।

সারা বিশ্ব এক ঘরে রাখলেও মিয়ানমারের এই অত্যাচারী সরকারকে আগলে রেখেছে চীন। তবে চীনের কৌশলও সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। ২০২১ সালে যে অভ্যুত্থান হয়, তখন চীন বলেছিল সামরিক বাহিনীর দেশ দখল সে দেখতে চায়নি। সু চির সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক রেখেও জান্তাকে সব সমর্থন দিয়ে গেছে চীন এবং এবারও দেখা যাচ্ছে দুপক্ষেই তার সমর্থন আছে।

একের পর এক এলাকা হারালেও দেশটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তাতমাদো অর্থাৎ সেনা শাসকের নিয়ন্ত্রণ এখনো বেশ নিরঙ্কুশ। দেশটির প্রধান জনগোষ্ঠী বামাররা বেশি থাকে এই মধ্যাঞ্চলে। সেনাবাহিনীও যেহেতু প্রধানত বামারদের, সে কারণে এই অঞ্চলে শিগগির তারা প্রভাব হারাবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও এখনো তাদের সঙ্গে আছেন। চীন দেশটির প্রান্তিক সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোকেও সহায়তা দিয়ে আসছে। এই সহায়তা সব ধরনের। যেহেতু মিয়ানমারজুড়ে চীনের বহু ধরনের বিনিয়োগ আছে, সে কারণে বেইজিং বহুদিন হলো এই কৌশলে কাজ করে চলেছে।

চলতি বিদ্রোহ বা যুদ্ধে চীন উভয় পক্ষেই আছে। যে জিতবে সেটাই চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রচণ্ড। সেই বিভাজন, জান্তা ও সশস্ত্র গোষ্ঠী উভয়ের ওপর বেইজিংয়ের প্রভাব—এমন একটি ত্রিশূল পরিস্থিতি চীন মিয়ানমারের আঞ্চলিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চীন আসলে খুব একটা এগোবে না। এর পরিবর্তে বরং, চীন সীমান্তে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে নেপিডোকে চাপ দেবে।

যুদ্ধে সেনা শাসক যত চাপে পড়বে, ততই কৌশল বদলাবে চীন। পুরোপুরি খোলামেলা সমর্থন না দিয়ে ভবিষ্যতে বেইজিং ইস্যুকেন্দ্রিক নীতি অনুসরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিজের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে চীন তার নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমারের সব পক্ষের ওপর রাখবেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঝালকাঠিতে পথসভায় হামলা, চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ আহত ১৫

পরিত্যক্ত সবজি থেকে পলিথিন, কলাগাছের তন্তু থেকে প্লাস্টিক তৈরি

ঢাকায় প্রথম দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন ডোনাল্ড লু

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে’

পথচারীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সোনালু ফুল

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট, অতঃপর...

চবি আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি কাওসার, সম্পাদক মিমি

চাল বিতরণে অনিয়ম, ইউপি সদস্য বরখাস্ত 

কয়রার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভা

ভিডিও দেখে আঙ্গুর চাষে সফল আনোয়ার

১০

ব্যাংক ১ টাকা দিয়ে ১০ টাকার জমি নিতে চায় : রাফসান

১১

অনিয়মের বেড়াজালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

১২

তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা: এরদোয়ান

১৩

গতিসীমার মধ্যে থেকেও ওভারটেকিংয়ের পথ দেখালেন ডিএমপি কমিশনার

১৪

বিপ্লবের পরিবারে যেন ঈদ আনন্দ

১৫

বাংলাদেশের ফুচকা বেস্ট : ডোনাল্ড লু

১৬

গুজব প্রতিরোধে সচেতনতা দরকার: পিআইবি মহাপরিচালক

১৭

বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করল একাধিক এয়ারলাইন্স

১৮

প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ছাত্রলীগের কর্মসূচি ঘোষণা

১৯

অসুস্থ তাঁতীদল নেতার পাশে আবুল কালাম আজাদ

২০
X