আলম রায়হান
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০২:১৬ এএম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০৯:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষমতার খেলায় জনগণ কার

ক্ষমতার খেলায় জনগণ কার

একসময়ে জনপ্রিয় জারিগানের আদলে দেশের রাজনীতিতে একধরনের বাহাস চলছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, টিকিয়ে রাখছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ভারত পাশে ছিল বলেই অন্য বৃহৎ শক্তি নির্বাচন ভন্ডুল করতে পারেনি। এই ভন্ডুল শব্দটির আবার বিভিন্ন রকমফের আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুটি। এক. আমি-তুমি-স্বামী-ডামি মিলিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন করা সম্ভব না হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অধিকতর কঠিন হতো। অসম্ভবও হতে পারত। এমনকি লালনের গানে খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতার মসনদ আওয়ামী লীগকে ছেড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। এমন অবস্থা হলে কে ক্ষমতায় বসত তা নিশ্চিত নয়। তবে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হতো—এটি নিশ্চিত। কিন্তু এমনটি হয়নি। এটি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তির। কিন্তু রাজনীতিতে কি স্বস্তি আছে! সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের রাজনীতির হালহকিকত কী?

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসীন হয়েছে গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের অসিলায়। তবে এটা প্রচলিত অর্থে কতটা নির্বাচন তা নিয়ে কারও কারও বিস্তর প্রশ্ন আছে। এ নির্বাচন যত না ভোটারনির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌশল প্রভাবিত। কেউ কেউ আবার কৌশল না বলে কূটকৌশল বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং আরও বলা হয়, এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রসঙ্গত, কৌশল ও কূটকৌশল প্রকৃতপক্ষে একই বৃন্তের দুটি ফুল। শুধু দেখার পার্থক্য। যে বিজয়ী হয় তার বিবেচনায় কৌশল আর পরাজিতের বিবেচনায় কূটকৌশল। ফলে কোনো নির্বাচনেই সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার সিল দেওয়ার উপায় নেই। একই অবস্থা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়েও। যে বিজয়ী সে বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আবার যে পরাজিত সে বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ফলে এ বিষয়টিকেও একবিন্দুতে এনে সমান মর্যাদা দেওয়ার উপায় নেই। সঙ্গে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তা হচ্ছে—শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর কোথাও নির্বাচন সব মহলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যতার তকমায় মহিমান্বিত হয় না। একই ধারায় আমাদের দেশে গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তা না হলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল কীভাবে? এ প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে। যে প্রশ্ন আছে বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলো নিয়েও। এ থেকে মুক্ত নয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনও।

আরও প্রশ্ন উঠবে, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি কী? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির দৃশ্যপটে যে দানব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা পরাজিত করতে আওয়ামী লীগকে ২১ বছর প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টায়টায় বিজয়ী হয়ে জোড়াতালির সরকার গঠন করে। আর বিষয়টি যত না ছিল ক্ষমতায় বসা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ক্ষমতার ছায়াতলে দন্তহীন ব্যাঘ্রের মতো আশ্রয় গ্রহণ। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ আবার রাস্তায়! ২০০১-এর নির্বাচন এবং পরবর্তী পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়। এরপরও মৃত্যুকে পদদলিত করার সাহস নিয়ে চলার পথে ২০০৪ সালে আরেকটি ১৫ আগস্টের মুখোমুখি হয় স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব প্রদানকারী দলটি। সেই দিনের ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু ঘটে, অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং টিকে যায় আওয়ামী লীগ। এরপর মৃত্যু যেন বঙ্গবন্ধুকন্যার পায়ের ভৃত্যে পরিণত হয়। রাজনীতির অনেক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আসে ২০০৮ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে শক্ত বিজয় ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে অন্যরকম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে। এরপরও সুদূরপ্রসারী কৌশল হিসেবে রাজনীতিতে কিছু আগাছাকে সরকারে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং অন্যকে রিড করার সুযোগ না দিয়েই তিনি নানান কৌশলে এগিয়ে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও সরকারকে। বলাই হয়, বিশ্বনেতায় উন্নত হওয়া শেখ হাসিনাকে রিড করা কারও কম্ম নয়!

এদিকে ১৫ আগস্টের নৃশংসতার আঁতুড়ঘরে জন্ম নেওয়া বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহা হোঁচট খেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। প্রকৃত বিবেচনায় প্রধান বিরোধী দলের তকমা ধারণ করেও সাবেক শাসক দলটি অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পের কিশোর ফটিকের দশায় বিরাজমান। ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচন বর্জন-প্রতিরোধ এবং দলের রেজিস্ট্রেশন রক্ষার খুচরা কৌশলী অংশগ্রহণের ধারায় চলতে চলতে বিএনপি পার করেছে তিনটি জাতীয় নির্বাচন। শুধু তাই নয়, সব ধরনের নির্বাচন থেকে দলটি এখন অনেক দূরে। এ অবস্থায় একমাত্র ভরসা কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে বিদেশ। পরিষ্কার করে বললে, আমেরিকা। রাজনীতির চাতক পাখি। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা জাতীয় পার্টির অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন! সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের রেখে যাওয়া এই দলটি এখন আওয়ামী লীগের দয়ার কাঙাল। ধনবান ব্যক্তির অর্বাচীন সন্তান এতিম হলে যেরকম দশা হয়। সামগ্রিক এই বাস্তবতায় সুলতান সোলাইমানের দাপটে দেশ চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর নেপথ্যে কাজ করছে নানান কৌশল, নানান শক্তি। কারও কারও দৃষ্টিতে যা অপশক্তি, অপকৌশল।

কৌশল-অপকৌশলের তাত্ত্বিক আলোচনার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আসলে কোথায়? জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার উৎস ছিল ক্যান্টনমেন্ট। তাহলে আওয়ামী লীগের কোথায়? এ প্রশ্নে জবাব এককথায় দেওয়া কঠিন। এ নিয়ে নানান কথা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে বিরোধী দলের অভিযোগ অনুসারে প্রধান হচ্ছে ভারত। এর সঙ্গে সহায়ক শক্তি হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপের আমলা। বিপরীতে আওয়ামী লীগের দাবি অনুসারে, তাদের ক্ষমতার উৎস জনগণ। এর মধ্য কোনটি সঠিক তা নিশ্চয়ই গভীর গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে অতিসাধারণ একজন সাংবাদিকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করা শোভন নাও হতে পারে। নিরাপদ তো নয়ই। এ বিষয়ে অন্য কারও কথা বা মতামত উদ্ধৃত করাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে অতি বিনয়ের সঙ্গে এটুকু বলা যায়, পৃথিবীর কোথাও আসলে জনগণ ক্ষমতার উৎস নয়। ক্ষমতার উৎস কখনো বন্দুকের নল, কখনো আবার বিভিন্ন ক্ষমতাকেন্দ্র। যেখানে কৌশল ও সফলভাবে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি হচ্ছে মুখ্য। বলা বাহুল্য, গণতান্ত্রিক ছদ্মাবরণেও চলে কৌশল আর বলপ্রয়োগের খেলা। সফল হলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, না হলে রাস্তায়। কারাগারে। এদিকে বন্দুকের জোরে সফল হলে সিংহাসন, না হলে ফাঁসির মঞ্চ। অথবা মাথায় গুলি। আমাদের দেশে হাতের কাছেই উদাহরণ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুরসহ অনেকে। ক্ষমতার খেলায় মসনদে আসীন হওয়ার এসব ধারায় জনগণের স্থান কোথায়? বাস্তবতা হচ্ছে, সেই প্রবচন—‘আমি কার খালু গো!’

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে লাশ হলেন বাবা

হিটস্ট্রোকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মৃত্যু

নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে অভিজ্ঞদের প্রাধান্য

বাবা-মা ঝগড়া করায় অভিযোগ নিয়ে থানায় হাজির শিশুসন্তান

ভারী বৃষ্টিপাতে বোরো ধান কাটতে কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শ

শীর্ষে থেকেও মোস্তাফিজ কেন পেলেন না পার্পল ক্যাপ?

তবে কি পিছু হটছে ইসরায়েলি সেনারা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও খোলা, কোথাও বন্ধ

রাজধানীতে ট্রেনে দুই পা কাটা পড়া যুবকের মৃত্যু

ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত

১০

মাদারীপুরে হিটস্ট্রোকে ২ জনের মৃত্যু

১১

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি

১২

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ‘অ্যালামনাই রিকানেক্ট’ অনুষ্ঠিত

১৩

আইএবি অ্যাওয়ার্ডস পেলেন যারা

১৪

এল নিনোর কারণেই বাংলাদেশে এত গরম!

১৫

সেই ছাত্রলীগ নেতাকে অব্যাহতি

১৬

ঝালকাঠিতে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

১৭

বায়ুদূষণে শীর্ষে বাগদাদ, ঢাকার অবস্থান কত?

১৮

তীব্র গরমে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যু

১৯

ব্যাংকক থেকে আজ দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী

২০
*/ ?>
X