মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:০৬ এএম
আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন যুগের ঈদ!

নতুন যুগের ঈদ!

এই ঢাকা শহরে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে যারা বসবাস করছে, তাদের ৮০ ভাগ মানুষ এসেছে কোনো না কোনো জেলা থেকে। ঢাকা শহর তারা বেছে নিয়েছে কর্মের প্রয়োজনে, ভাগ্য বদল করতে। প্রত্যেক মানুষ, প্রতিটি পরিবার জীবন নিয়ে এই ইট-পাথরের শহরে ছোটাছুটি করলেও মনের কোণে লালন করে রাখে নিজের জন্মস্থান, জন্ম-ঠিকানা। ব্যস্ত কর্মজীবনে হঠাৎ মনের মধ্যে উঁকি দেয় বাড়ির উঠানের কোনো গাছ, নিকটজনের মুখ, বাড়ির অদূরে এঁকেবেঁকে যাওয়া নদী অথবা পথ। সারা বছর কর্মময় জীবনে ঈদের ছুটিতে ঘরে ফেরার অপেক্ষা জমতে জমতে অবশেষে যখন ছুটিটা সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন ভেতরের মানুষটা যেন হয়ে ওঠে এক ছুটন্ত ঘোড়া! সবাই যেন ঈশ্বরচন্দ্রের মতো ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে মায়ের কাছে ফিরতে প্রস্তুত।

কিন্তু বিড়ম্বনাটা শুরু হতো তখনই। মন চলে গেছে বাড়ি আর দেহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে আছে বাসস্ট্যান্ডে, সড়কে, যানজটে, টিকিট না পাওয়ার বিড়ম্বনায়। এক-দুজন নয়, হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষকে একইরকম করে সড়কে যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রতি বছর। এ বাড়ি যাওয়ার তাগিদে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষকে রাস্তায় প্রাণ দিতে হয়েছে।

এই প্রথম মানুষের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়তে দেখা যাচ্ছে। সরকার তথা সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা মন দিয়েছিলেন অবকাঠামো উন্নয়নে এবং সত্যি কথা বলতে আপত্তি নেই, বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কল্পনাকে নামিয়ে এনেছেন হাতের মুঠোয়। ২২ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নেটওয়ার্কের চলাচল স্বচ্ছ করতে মহাসমারোহে কাজ চলমান। এসব সড়ক প্রশস্তকরণ, সার্ভিস লেনসহ চার লেনে উন্নীতকরণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বৃহৎ পদ্মা সেতুসহ দেশব্যাপী ছোট-বড় সেতু এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে এবার এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ছে। একটি মাত্র মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তাতেই ঢাকা শহরের রসায়ন অনেকটা পাল্টে গেছে। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট-৬ নামক প্রকল্পের দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার পথ পার হতে সময় লাগছে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। অবিশ্বাস্যই বটে! এ পথটুকু পার হতে পুরো একবেলা সময় যেত। প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ মানুষ এ সুবিধা গ্রহণ করছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির এ ঢাকা শহর গতির সঞ্চার করতে শুরু করেছে। ধরুন কেউ যদি এখন চায় যে উত্তরা থেকে মতিঝিল গিয়ে একটি কাজ সেরে তার বাড়ি খুলনায় যাবেন, তাহলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা সম্ভব! এ যেন সত্যিই বিশ্বাস হতে চায় না। উন্নয়নশীল দেশের সরকারের হাজার দোষ থাকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারেরও আছে। কিন্তু নতুন বাংলাদেশের এই গতি অস্বীকার করলে তা হয়ে যাবে মোনাফেকি!

পদ্মা সেতুর পর রেলসেতু সংযোগ হওয়ায় দক্ষিণ বাংলার মানুষই শুধু নয়, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষরাও যেন স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন দেখতে না দেখতে এখন দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থানে পরিণত হয়েছে। ডুবে গিয়েছিল বাংলাদেশের রেল। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। বাল্যকালে মায়ের সঙ্গে ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ী যেতে ফরিদপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছি। তখন রেলযাত্রীদের অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুতিই থাকত। সঙ্গে খাবার-পানি নিয়ে বের হতো মানুষ। কারণ ট্রেন কয় ঘণ্টা পর আসবে কেউ জানে না। কোনো দিন কোনো ট্রেন সময়মতো ছেড়ে যেতে দেখা যেত না। যাহোক, রেলওয়ে স্টেশনের বিশ্রামাগারে মায়ের সঙ্গে বসে ছারপোকার কামড় খাচ্ছি। ট্রেনের সরকারি সময় সকাল ৮টা। তালমা বা পুকুরিয়া পর্যন্ত তখন রেল যেত। হঠাৎ সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলে এলো। আমার মা একটু ভড়কে গেলেন। দ্বিধায় পড়ে গেলেন। আমার সুশিক্ষিতা সরকারি চাকরিজীবী মা উঠে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে জানতে চাইলেন, ট্রেন তো ৮টায় পৌঁছানোর কথা, এখন যে? স্টেশন মাস্টার অতি সাধারণ নির্লিপ্ত চেহারা রেখেই উত্তরে বললেন, এটা গতকাল বিকেলের ট্রেন। তার মানে পরের ৮টার ট্রেন যে কখন আসবে তা রেলওয়ের মহাপরিচালক তো দূর কি বাত, খোদ ঈশ্বরও হয়তো জানতেন না! এ অবস্থাই চলেছে যুগের পর যুগ। শোনা যায়, শুধু অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিই নয়, রেলওয়ের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল যাতে কোনোক্রমেই অনুন্নত জনবহুল দেশে রেল জনপ্রিয় না হয়। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে নাকি দুটি মোটিভ কাজ করত। একটি হলো, রেল শ্রমিকরা শক্তিশালী ইউনিয়ন হয়ে যাতে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা কবজা করতে না পারে। আর সত্তর বা আশির দশকে ইউনিয়ন মানেই তো বাম রাজনীতি। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা দেশগুলো সড়ক নির্মাণে ধার-হাওলাত দিতে শুরু করে। তাতে গাড়ি কোম্পানিগুলোর বেজায় বেচাকেনা বাড়ে।

অনেককাল পর প্রাণ ফিরে পেয়েছে রেলওয়ে, টেনে জাগিয়ে তুলেছে রেল নেটওয়ার্ক বর্তমান সরকার। আসছে নতুন নতুন ইঞ্জিন, বগি। ট্রেন ছুটছে কক্সবাজার। ট্রেনের শিডিউলও আগের মতো নেই। এমনকি সামর্থ্যবান মানুষরাও ট্রেনের টিকিট পেলে আর বিমানে উঠে বসার চিন্তা করছে না। তবে সমস্যার যে সমাধান হয়ে গেছে তা নয়। গত রোববার দেখা গেল কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন শিডিউল মিস করেছে। হাজার হাজার যাত্রীকে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এটাকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই বিশ্বাস করতে চাই। এ কথাও সত্যি, রেলওয়ের পুরোনো সব কর্মচারী এখনো নতুন গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না।

আরও একটি কঠিন সত্য হলো, ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের সাধারণ অনেক মানুষ এখনো গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। খুব ভদ্রভাষায় যদি বলি, তাদের মধ্যে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ছুটে আসা ট্রেনের সামনে দিয়ে পার হতে যাওয়া মানুষের মৃত্যু ঘটলে সে দায়ও তৃতীয় বিশ্বে সরকারকে নিতে হয়। বছর শেষে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যায় ওই মৃত্যুটিও থাকে। এটা যেমন সত্যি, আবার বহু ক্ষেত্রে সরকার তথা প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না। যেমন এ ঈদের সময় এলে আনফিট গাড়ি রাস্তায় রং করে নামানো হয়। যারা চালায় তাদের অনেকেরই লাইসেন্স থাকে না, হেলপার থেকে স্টিয়ারিং ধরা শিখেছে এমন লোকের হাতে ৫০-১০০ জন মানুষের জীবন ছেড়ে দেওয়া হয়। যারা গাড়িগুলো চালায় তারা যেমন ট্রাফিক সংকেতগুলো চেনে না, আবার বহু রাস্তায় ট্রাফিক সংকেত নেই। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ কঠোর হয় না দুটি কারণে। প্রথমত, তাদের বাড়তি আয়, দ্বিতীয়ত কারণ বাসমালিকদের প্রভাব।

সারা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত সড়ক জালের মতো বিছিয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এটি একটি বড় ব্যর্থতা। এই জালের মতো বিছিয়ে থাকা রাস্তায় এখন নেমেছে লাখ লাখ মোটরবাইক। মহাসড়কগুলোতে অবলীলায় চলছে থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন নামের শ্যালো ইঞ্জিন লাগানো স্থানীয় তৈরি বাহন। এসব কারণে এ নিশ্চয়তা এখনো দেওয়া যাবে না যে, ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের মৃত্যু সংখ্যা নামিয়ে আনা যাবে। এ বছরও আমাদের গুনতে হবে বাড়িতে যেতে কত মানুষ প্রাণ হারাল। সেজন্যই আমরা বারবার বলি, অবকাঠামো উন্নয়নই শেষ কথা নয়, দেশের নাগরিকদের নাগরিক দায়িত্ব-কর্তব্য শেখানোটাও সরকারের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর সেটা শেখাতে গেলে সবার আগে নিজেদের জানতে হয়, নাগরিক দায়িত্বটা কী।

তবুও আশা জাগে আমাদের, প্রতিটি মানুষ কর্মময় জীবন থেকে ক্ষণিকের শান্তির খোঁজে গিয়ে যেন সুস্থ ও সবল হয়ে ফিরে আসে। উদ্দীপনা নিয়ে আবার যার যার কর্মে নেমে পড়ে। ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে দেশের সব মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘পিডাইয়া লম্বা করে দেন, বহু উপরের নির্দেশ’

পাকিস্তানের হাতে অত্যাধুনিক রকেট, আতঙ্কে শত্রুদেশগুলো

আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ১৭ মে

মহাসড়কে হঠাৎ গুলি, নারী আহত

‘চট্টগ্রাম বন্দর একদিন পৃথিবীর অন্য দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে’

শাবিতে মাহিদ মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

‘বারবার নীতি পরিবর্তন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আস্থা কমে যাবে ব্যবসায়ীদের’

হাজিদের স্বাগত জানাচ্ছে নারীরা!

কক্সবাজারের রূপে সাজবে পতেঙ্গার সি-বিচ

সরকার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই : মির্জা ফখরুল

১০

ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে গরু ছিনতাইয়ের মামলা

১১

উচ্চশিক্ষার জন্য নরওয়েতে যাচ্ছেন চুয়েটের ৮ শিক্ষার্থী

১২

পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পাওয়া গেল তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ

১৩

অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকায় আরেক ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শনাক্ত

১৪

গাজীপুরে যাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন

১৫

নাশকতার ১৪ মামলায় স্থায়ী জামিন পেলেন আবদুস সালাম

১৬

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আসিম জাওয়াদের পরিবারের সাক্ষাৎ 

১৭

চট্টগ্রামে আ.লীগ নেতা আটক

১৮

৫০ বছর ধরে রোজা রাখা সেই হতদরিদ্র বৃদ্ধ যাচ্ছেন হজে

১৯

নিউ কালিডোনিয়াজুড়ে বিক্ষোভ, জরুরি অবস্থা জারি

২০
X