নির্বাসন কাকে বলে? যখন কেউ মন থেকে, স্মৃতি থেকেও মুছে ফেলতে চায় কাউকে? নির্বাসন শব্দটির মধ্যেই কেমন একাকিত্বের ঘ্রাণ লেগে থাকে আর কোনোদিন ফিরে না আসার ধ্বনি পাঁজরে আঘাত করে। আর কোথাও ছায়া পড়বে না আর দেখতে পাওয়া যাবে না প্রিয় মুখ, শোনা যাবে না প্রিয় গান, যাওয়া যাবে না প্রিয় মানচিত্রে ফিরে।
কারা নির্বাসিত করে মানুষকে? কেন করে? পৃথিবীতে নির্বাসন দণ্ড নতুন কিছু নয়। বিপ্লবীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে মাটিচাপা দিতে চাওয়া হয়েছে বিপ্লবকে। সাহিত্যিকদের নির্বাসনে পাঠিয়ে কণ্ঠরুদ্ধ করতে চাওয়া হয়েছে সত্যের। গুম করতে চাওয়া হয়েছে কিছু স্বপ্ন চিরকালের জন্য। কিন্তু তারপর? দূরে গিয়ে মৃত্যু ঘটেছিল নির্বাসিতের সব স্বপ্নের, সব লেখার, সব আশার? দান্তে, অস্কার ওয়াইল্ড, পাবলো নেরুদা, আলেকজান্ডার সোলঝানেৎসিন, ভিক্টর হুগো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড মাথায় নিয়েছিলেন নির্বাসনের দণ্ড। বিতাড়িত হয়েছিলেন নিজ বাসভূম থেকে। এই বাংলাদেশ থেকেও নির্বাসিত হয়ে কবি দাউদ হায়দার পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়েছেন পৃথিবীকে বিদেশের মাটিতে থেকেই। আর তসলিমা নাসরীন? তিনি আজও নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন ভিনদেশের মাটিতে। কিন্তু নির্বাসন কি তাদের কলমকে স্তব্ধ করতে পেরেছে? ভিন্ন জলবায়ু, ভিন্ন মানচিত্রে দাঁড়িয়েও তারা লিখেছেন, মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ধর্ম আর রাজনীতির কাঁধে ভর করে স্বৈরাচারী শাসক, ধর্মীয় নেতা আর সমাজ অভিযোগের আঙুল তুলেছে লেখকের দিকে। তাদের আক্রমণ করেছে, বিতাড়িত করেছে তারই স্বদেশ থেকে।
দুটি গোত্রের রাজনৈতিক সংঘাত এবং ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে দান্তেকে ফ্লোরেন্স ছাড়তে হয়েছিল। তাকে নির্বাসনে পাঠানোর সময় শাসকরা বলে দিয়েছিলেন, আর কোনোদিন ফ্লোরেন্সে ফিরলে তাকে হত্যা করা হবে। পরবর্তী ২০ বছর তিনি ছিলেন ঘরছাড়া। তখন ইতালির বিভিন্ন শহরে যাযাবর জীবনযাপন করেন তিনি। আর তখনই লেখা হয়েছিল তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত তার অমূল্য কাব্য ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’। কবি দান্তে তার জীবদ্দশায় আর কখনোই ফ্লোরেন্সে ফিরে আসতে পারেননি।
সম্রাট নেপোলিয়ানের বিরোধিতা করাই ছিল ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর অপরাধ। তাই তাকে দেশ থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। হুগো চলে যান বেলজিয়ামে। সেখানে বসে পাতা ঝরেপড়া কোনো এক সন্ধ্যায় এক বন্ধুকে চিঠি লিখছিলেন। চিঠিতে নির্বাসিত লেখকের বেদনা ঝরে পড়েছিল পাতার মতো এভাবে, ‘নির্বাসন দিয়ে আমাকে শুধু ফ্রান্স থেকেই বিচ্ছিন্ন করা হয়নি, পৃথিবী থেকেই যেন পৃথক করে দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাসিত হুগো দেশ ছাড়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘লে মিজারেবল’ ও ‘টয়লার্স অব দ্য সি’ উপন্যাসের লিখিত কিছু অংশ। উপন্যাস দুটি নির্বাসিত জীবনে থেকেই শেষ করেন।
পাবলো নেরুদার নির্বাসিত জীবনের গল্পে মেক্সিকো, ইতালি ও ফ্রান্স একটি বড় অংশ হয়ে আছে। প্রথম জীবনে তিনি চিলি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মার্ক্সবাদ সমর্থন করার অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে চিলির স্বৈরাচারী সরকার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করে। তার চিলির বন্ধুরা তাকে এক মাস আত্মগোপনে থাকতে সাহায্য করেন। তারপর একদিন তাদের হাত ধরে চিলির কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড় টপকে নেরুদা পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়। সেখানে বসবাসের সময় তিনি একটি কবিতার বই এবং ১৫ হাজার লাইনে ‘হিস্ট্রি অব হিস্পানিক আমেরিকা’ বইটি রচনা করেন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগুন যখন জ্বলে ওঠে, নেরুদা সেখানেই বসবাস করছিলেন। রিপাবলিকানদের পক্ষ অবলম্বন করেন কবি। আর তাতেই তার মাথার ওপর আবারও নেমে আসে নির্বাসন দণ্ড। নেরুদা চলে যান মেক্সিকো। পরে তার অস্থায়ী নিবাসের ঠিকানা হয় ইতালি। ১৯৭১ সালে আবার স্বদেশে ফিরে আসেন নেরুদা। নোবেল পুরস্কার তখন তার করতলগত। চিলির ক্ষমতায় বসেছে মার্ক্সবাদী সরকার। এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের খুব কাছের মানুষ ছিলেন পাবলো নেরুদা। কিন্তু এই নৈকট্যই তাকে দ্বিতীয়বার দেশছাড়া করে। ১৯৭৩ সালে মার্কিন ষড়যন্ত্রে রক্তাক্ত সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিহত হন আলেন্দে। ক্ষমতায় বসে স্বৈরাচারী পিনোসে সরকার। মেক্সিকো এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূতরা নেরুদা ও তার স্ত্রীকে তাদের দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানান। ওই টালমাটাল সময়ে নেরুদার বাড়ি তল্লাশি করতে আসা সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘খুঁজে দেখো, এখানে কবিতা ছাড়া তোমাদের ভয় পাওয়ার মতো আর কিছু নেই।’
সিগমুন্ড ফ্রয়েড নির্বাসিত হয়েছিলেন ভিয়েনা থেকে। ঠিক নির্বাসন নয়, বলা যায় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর খুনি দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে। সময়টা ১৯৩৮ সাল। ৮২ বছর বয়সী ফ্রয়েড লন্ডনে বসে অসমাপ্ত ‘অ্যান আউটলাইন অব সাইকো-অ্যানালাইসিস’-এর কাজ গোছানো শুরু করেন। ভিয়েনায় থাকার সময় তিনি বইটি লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বইটির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কাজ গুছিয়ে ফেলেন। কিন্তু শেষ দৃশ্যে এসে তাকে আটকে দেয় ক্যান্সার। কর্কট রোগ অনেক দিন আগেই তার শরীরে ঘর বেঁধেছিল। কাজ শেষ হলো না। সব ফেলে চলে গেলেন পরপারে। তার মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৩৯ সালে তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশিত হয়।
অস্কার ওয়াইল্ডের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানান কাহিনি। হোমোসেক্সুয়্যালিটি আর উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে আয়ারল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হন ওয়াইল্ড। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ‘পিকচার অব দ্য ডরিয়ান গ্রে’ উপন্যাসের লেখক। ছদ্মনাম নিয়ে বেশ অনেক দিন বাঁচতে হয়েছিল এ নাট্যকার ও ঔপন্যাসিককে। তখন সাহিত্য নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে অস্কার ওয়াইল্ডের মন। শুধু কতটা বিরক্তি মনের মধ্যে জমা হয়েছে, তা বোঝার জন্য আরও কয়েক বছর লেখালেখি চালিয়ে যান তিনি। নির্বাসিত হওয়ার পাঁচ বছর পর ওয়াইল্ডের মৃত্যু হয়।
লেখালেখির জন্যই ইংল্যান্ড থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন ডি এইচ লরেন্স। যতদিন বেঁচে ছিলেন দেশের মাটি তার জন্য ব্রাত্য হয়েই ছিল। বাকি জীবন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর নিরন্তর লিখে গেছেন। নির্বাসিত জীবনে ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটি লিখে অশ্লীলতার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন লরেন্স।
টমাস মান দণ্ড পেয়েছিলেন জাতীয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে খোলামেলা কথা বলে এবং হিটলারের নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে লিখে প্রতিবাদ করায়। ওই সময়ে সুইজারল্যান্ডে অবকাশ ভ্রমণে যান টমাস মান। সেখানে বসেই পান ছেলের টেলিগ্রাম। ছেলে জানায়, স্বদেশ ভূমি জার্মানি আর তার জন্য নিরাপদ নয়। ওই সময়ে তিনি জার্মানির নাগরিকত্বও হারান। অবশ্য ১৯৩৬ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ডের ছোট্ট এক শহর অথবা গ্রাম ভেরমন্ট। আর এখানেই নির্বাসিত জীবনের বিশ বছর কাটিয়েছেন তৎকালীন সোভিয়েত রুশ ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিন। বলশেভিক বিপ্লবের এক বছর পর ১৯১৮ সালে সোলঝেনিৎসিনের জন্ম। স্তালিনের শাসনামলে লেখায় কমিউনিস্ট সরকারের নীতির সমালোচনা করে গ্রেপ্তার হন তিনি। তাকে আট বছরের নির্বাসন দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাজাখস্তানে। স্তালিন যুগের অবসান হলে আবার দেশে ফেরেন সোলঝেনিৎসিন। তখন তাকে লেখা প্রকাশের অনুমতিও দেন তৎকালীন সোভিয়েত সরকার। ওই সময়ে তার লেখা পৃথিবীখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান দোনিসোভিচ’ প্রকাশিত হয়। সেই উপন্যাসটি ছিল রুশ সরকারের বন্দিশিবিরের নির্মম জীবন নিয়ে লেখা।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সোভিয়েত সরকারের সমালোচনা করার কারণে সোলঝানিৎসিনের জীবন আবারও শাসকদের রক্তচক্ষু দেখে। ১৯৭০ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও এ সাহিত্যিক পুরস্কার আনতে যেতে পারেননি। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একবার দেশ ছেড়ে গেলে সরকার তাকে আর ফিরে আসতে দেবে না। ১৯৭১ সালে রুশ গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা তাকে খুন করার জন্য হামলাও চালায়। কোনোক্রমে বেঁচে যান। শেষে সোলঝেনিৎসিনের জন্য অপেক্ষা করছিল নির্বাসন। ১৯৭৪ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অনেক দেশ ঘুরে শেষে জীবনের শেষ পর্বে এ সাহিত্যিক পরবাসী হন ভেরমন্টে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর তিনি আবার দেশে ফেরার অনুমতি পান। ২০০৮ সালে মস্কোতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র: বুকস টেল ইউ হোয়াই, মেন্টাল ফ্লস, হিউম্যানিটিজ
মন্তব্য করুন