ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত গণহত্যার প্রতিবাদে সোমবার সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এসব মিছিল থেকে অতিউৎসাহী কিছু লোক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এদিন সিলেটেই ফুড চেইনশপ কেএফসি এবং জুতার আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাটার আটটি শোরুমসহ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় অন্তত ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিনিধিরা। সচেতন নাগরিকসহ স্থানীয়রা বলছেন, এমন ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি সিলেটবাসী। গত ৫ আগস্ট এত বড় ঘটনার পরও এমন ভাঙচুর ও লুটপাট হয়নি। এমন ঘটনায় সম্প্রীতির দেশ সিলেটে কালি লেগে গেল।
সোমবারের ঘটনায় এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে সিলেটের ব্যবসায়ীদের মনে। ভাঙচুরের আশঙ্কায় গতকাল মঙ্গলবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেননি অনেকেই। এদিন সকালে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ঘটনাটি ন্যক্কারজনক। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, যে বা যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত আছে, তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ১৮ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হোটেল রয়েল মার্কের ম্যানেজার (অপারেশন) আব্দুল মতিন সরকার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় আটক ১৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, সিলেটে সবকটি শোরুম বন্ধ রয়েছে ভাঙচুর আতঙ্কে। কেএফসি, পিৎজা হাট, রয়েল মার্ক, হোটেল সফুরা রেস্টুরেন্টসহ বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের সামনে মোতায়েন করা হয়েছে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের। ক্ষতিগ্রস্ত আম্বরখানা, জিন্দাবাজার, দরগা গেট, লন্ডন ম্যানশন, বারুতখানা, বন্দরবাজার মধুবন সুপারমার্কেটে বাটার শোরুমে শাটার লাগিয়ে এবং প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে ঢেকে মেরামতের কাজ চলছে। শুধু সুপার মার্কেট কিংবা শোরুম নয়, ভাঙচুর করা হয়েছে ফুলকলি, বনফুলসহ শতাধিক দোকানে। বাদ যায়নি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের আশপাশে থাকা ছোটখাটো মুদি দোকান কিংবা পান-সিগারেট বিক্রির টং দোকানও।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় সিলেটের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় নাগরিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। হোটেল রয়েল মার্ক ও সফুরা রেস্টুরেন্টের মালিক বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান ঘটনাটিকে ন্যক্কারজনক আখ্যায়িত করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে, আমরা মুসলমান; কিন্তু আমাদের হোটেলে যে ভাঙচুর হয়েছে, সেটি প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ নয়, এটা ছিল পরিকল্পিত হামলা।’
তিনি বলেন, ‘হোটেলের রিসিপশন, জুস কর্নার, ফার্নিচার, গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রসহ পুরো হোটেলই ধ্বংস করা হয়েছে। আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার। এর সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মুজিবুর রহমান মিন্টু গতকাল সকালে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাই; কিন্তু সিলেটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট একেবারে অগ্রহণযোগ্য। সিলেটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। এগুলোর ওপর হামলা মানে অর্থনীতির ক্ষতি করা। এ ঘটনায় শতাধিক দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা প্রাথমিক হিসাব করেছি।’
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের আহ্বায়ক আব্দুল করিম কিম। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘গাজায় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে সিলেটের রাজপথে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো মানুষ শোক ও ক্ষোভের অনুভূতি নিয়ে সমবেত হয়েছিল; কিন্তু সেই মানবিক আয়োজনে কালিমা লেপন করে দেয় একদল দুর্বৃত্ত। যে গণহত্যায় শিশুদের লাশের মিছিল দেখে বিশ্বময় মানুষ অশ্রুসিক্ত হচ্ছে, সে ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর নামে একদল দুর্বৃত্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে, লুট করে বলছে ‘ঈদ মোবারক’। তাদের চোখেমুখে কোনো শোক নেই। নিপীড়িত মানুষের প্রতি সংহতি জানানোর কোনো আবেগ নেই। এরা লুটতরাজ করতেই পথে নেমেছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা এক হয়ে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করুন। এরই মধ্যে প্রশাসন ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু এটা শুধু শুরু। আরও অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে সিলেটে পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।’
ক্ষতিগ্রস্ত আলপাইন রেস্টুরেন্টের মালিক ও জাসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্ববাসী গাজার এই নৃশংসতার প্রতিবাদে সংহতি প্রকাশ করেছে। আমরাও সংহতি প্রকাশ করেছি, অংশ নিয়েছি; কিন্তু ধর্মের নামে, একদল দুর্বৃত্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিশ্ববাসী ও সারা দেশের কাছে আমাদের সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।’
সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী বলেন, ‘আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। পুলিশ এরই মধ্যে অ্যাকশন নিয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করছে।’ তিনি বলেন, ‘ভাঙচুর ও লুটপাট কখনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, যে দলেরই হোক না কেন, জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী হামলা ও লুটপাটের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের কোনো রাজনৈতিক কিংবা মানবিক উদ্দেশ্য নেই। তারা মূলত চোর ও লুটেরা, যারা প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে বিশ্বাসী। এবং যারা এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা ব্যবসায়িক সংগঠনসহ সবার সঙ্গে বসেছি এবং প্রতিটি স্থান পরিদর্শন করেছি। আমরা সবাই একমত হয়েছি, যে বা যারাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তিনি যে-ই হোক, কোনো ছাড় নেই।’
মন্তব্য করুন