বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও কোটা সংরক্ষণের অজুহাতে বঞ্চিত হয়েছেন ৬৭২ প্রার্থী। সমসংখ্যক শূন্যপদ থাকলেও শুধু কোটার অজুহাতে তাদের পদায়ন হয়নি। এ ঘটনা ঘটেছে ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে। অথচ আগের ও পরের চারটি বিসিএসে কোটা সংরক্ষণের নামে কোনো পদ শূন্য রাখা হয়নি। এমনকি কখনো বিষয়টির আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়নি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। গত ২০১৫ সালের পর পদায়ন পেতে ওই উত্তীর্ণরা বিভিন্ন সময়ে দাবি জানিয়েছেন। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে রিট করেন বৈষম্যের শিকার এসব প্রার্থী। পরে আদালত প্রার্থীদের পক্ষে এ সংক্রান্ত একটি রুলও জারি করেন। তবে কোনো কিছুতেই টনক নড়েনি পিএসসির। গত ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তারা ওই শূন্য ৬৭২ ক্যাডার পদে পদায়নের দাবি অব্যাহত রেখেছেন। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ সংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পিএসসির বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়। এতে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত করা হয় ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ৮ হাজার ৭৬৩ জনের মধ্য থেকে ২ হাজার ১৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়। বাকি ৬ হাজার ৫৮৪ জন পাস করার পরও ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়নি। ওই বছর ৩৫টি ক্যাডারে ৬৭২টি পদ মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য শূন্য রাখা হয়।
৩৪তম বিসিএসের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি এবং চূড়ান্ত ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই বছর বিসিএস সাধারণ ক্যাডার পদে পাঁচটি, প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডার পদে ১১১টি (সহকারী সার্জন ৭৪, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১৩, ভেটেরিনারি ১৪, সাধারণ শিক্ষা (প্রভাষক) ক্যাডারে ২৭৪টি এবং সাধারণ শিক্ষা (প্রভাষক) সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের ক্যাডার পদে ১৪টি অর্থাৎ প্রায় ৩৫টি ক্যাডারে ৬৭২টি পদ শূন্য রেখে ফল দেওয়া হয়। ৩৪তম বিসিএস উত্তীর্ণ অনেকের এটি ছিল শেষ বিসিএস। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ ও সুপারিশ করতে প্রায় দুই বছর ৭ মাস সময় লেগে যায়। এতে অনেক প্রার্থীর চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হয়ে যায়। তাই বঞ্চিত ৩৪তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীরা ৬৭২ পদে মেধার ভিত্তিতে পদায়ন চান।
প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো আবেদনে বলা হয়, বিসিএস (কৃষি) কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা পদে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ্য শূন্যপদ ছিল চারটি; কিন্তু পিএসসি সুপারিশ করেছে ২৭৫টি, প্রশাসন ক্যাডারে পদ ছিল ২০০টি; কিন্তু পিএসপি সুপারিশ করেছে ২৯৩টি, পুলিশ ক্যাডারে পদ ছিল ৮০টি; কিন্তু সুপারিশ করেছে ১৪৮টি, মৎস্য ক্যাডারে পদ ছিল ৩১টি; সুপারিশ করেছে ৭৫টি, গণপূর্ত ক্যাডারে পদ ছিল দুটি; সুপারিশ করেছে ১৯টি। একই ফলে এমন অসংগতি এবং বৈষম্য দেখে বঞ্চিত প্রার্থীরা অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত।
ক্যাডারবঞ্চিত জাহিদুল ইসলাম জনি বলেন, ৩৪তম বিসিএসের বৈষম্যপূর্ণ ফল প্রকাশের পর থেকে আমরা ক্যাডারবঞ্চিত প্রার্থীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দিই। ক্যাডারবঞ্চিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বৈষম্যপূর্ণ ফলের শূন্যপদে নিয়োগে হাইকোর্টে রিট করা হয়। শূন্যপদে সুপারিশ প্রদানে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর পিএসসিকে নির্দেশ দেন। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও শূন্যপদগুলোতে সুপারিশ করেনি পিএসসি।
আরেক প্রার্থী মো. কামরুল ইসলাম রাশেদ বলেন, ৩৪তম বিসিএসের কোটা বৈষম্যের শিকার প্রার্থীরাই ২০১৫ সালে শাহবাগে প্রথম এ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র হয়। নির্বাহী বিভাগের নির্দেশনায় ৩৪তম বিসিএসে ৬৭২টি শূন্য ক্যাডার পদের বিপরীতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মেধার ভিত্তিতে সুপারিশ প্রদানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
৩৪তম বিসিএসে কোটা বৈষম্যের শিকার মো. তফিজুল ইসলাম বলেন, আমরা ৩৪তম বিসিএসের প্রার্থীরাই সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে সরাসরি কোটা বৈষম্যের শিকার হই। কোটা বৈষম্যের কারণে আমরা ২০১৫-১৬ সালে ব্যাপকভাবে আন্দোলন করেছিলাম। শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক চাকরিপ্রার্থী তখন গ্রেপ্তার ও ধরপাকড়ের শিকার হন। সম্প্রতি আমরা প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নিযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা, ক্রীড়া ও যুব উপদেষ্টা, প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টাসহ জনপ্রশাসন সচিব এবং পিএসসি চেয়ারম্যানকে আবেদনপত্র দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো দপ্তর থেকে সাড়া দেয়নি। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী ৫ অক্টোবর বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করব। আমাদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। এখন বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে আমাদের সমস্যার সমাধান না হলে কোনো উপায় থাকবে না।
মো. তফিজুল ইসলাম বঞ্চিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে তৎকালীন সরকারের অসাংবিধানিক, অমানবিক ও কোটা বৈষম্যমূলক আদেশ বাতিল করে বর্তমান সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সমাধান করে ৩৪তম বিসিএসের ৬৭২টি শূন্য ক্যাডার পদে মেধার ভিত্তিতে সুপারিশ করে পদায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
পিএসসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, একটি বিসিএস শেষ হওয়ার পরে ওইটা নিয়ে পিএসসির আর কোনো কাজ থাকে না। কারণ, পিএসসির কাজই সুপারিশ করা। তবে আদালতের রায় থাকলে প্রার্থীরা তাদের প্রাপ্যটুকু অবশ্যই পাবেন। এখন যদি কোনো বিসিএস বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকে, সেখানে পিএসসির কিছু করার নেই। সরকারই একমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক বলেন, ৩৪ বিসিএসের ক্যাডার পদে শূন্য ৬৭২ পদে নিয়োগ দিতে আইনি জটিলতা নেই। বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন না থাকলে উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে ৬৭২ শূন্যপদে অবশ্যই মেধার ভিত্তিতে পদায়ন হওয়া উচিত। কারণ, তারা তো পড়াশোনা করেই মেধার পরিচয় দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।