সংসদ সদস্যদের প্রাপ্য নানা সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনার সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তাদের শুল্কমুক্ত গাড়ি, আবাসিক প্লট, সব ধরনের প্রটোকল ও ভাতা পর্যালোচনা করে সংশোধনেরও কথা বলেছে কমিশন। শুধু তা-ই নয়, একটি ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ন করে সদস্যদের বার্ষিক সম্পদের হিসাব প্রদান এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া এমপিদের বিশেষ প্রটোকল বাতিল করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশন সূত্র জানায়, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং এমপিরা বৈধভাবেই সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা দেশের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক বেশি। এরপরও এসব জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। নিজেদের পদপদবিকে ব্যবহার করেই এসব সম্পদ গড়েন তারা। শুধু তা-ই নয়, শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা নিয়ে নিজের গাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করে দেওয়ারও ঘটনা ঘটে। সেজন্য বর্তমান আইনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত এসব জনপ্রতিনিধির অবাঞ্ছিত সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনা ও কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নিজেদের সুপারিশ সংবলিত এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেসব সুপারিশের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সুপারিশের সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বর্তমানে ‘দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, একজন মন্ত্রী মাসিক ১ লাখ ৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। আর প্রতিমন্ত্রী ৯২ হাজার, উপমন্ত্রী ৮৬ হাজার ৫০০ এবং এমপি পান ৫৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সরকারি বাসা পান। সেইসঙ্গে বাসভবনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন ব্যয় সরকারই বহন করে। বাড়ি সাজসজ্জা করতে একজন মন্ত্রী প্রতি বছর ৫ লাখ টাকা, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ৪ লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন।
কেউ সরকারি বাসায় থাকতে না চাইলে মন্ত্রী মাসিক ৮০ হাজার টাকা এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ৭০ হাজার টাকা করে ভাড়া পাবেন। নিজ বাড়ি বা ভাড়া বাড়িতে বসবাস করলে সেটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে তিন মাসের বাড়ি ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা পাবেন তারা।
এমপিরাও আবাসনের জন্য সরকারি ফ্ল্যাট পান। বিশেষ করে ন্যাম ভবনে তাদের জন্য ফ্ল্যাট বরাদ্দ থাকে। সরকারের কাছ থেকে রাজউকের প্লটও পান তারা। সেইসঙ্গে বাসায় টেলিফোন ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮০০, লন্ড্রি ভাতা দেড় হাজার এবং মাসিক ক্রোকারিজ ও টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ৬ হাজার টাকা করে ভাতা পান। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের জন্য প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে পান তারা।
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা সরকারি খরচে একটি করে গাড়ি সুবিধা পান। এ ছাড়া সংসদ সদস্য হওয়ার পর শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধাও পান তারা। সংসদ সদস্যরা মাসিক ৭০ হাজার টাকা করে পরিবহন ভাতা পান। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকার যাওয়া-আসার ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পান। জ্বালানি বাবদ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী দৈনিক ১৮ লিটার জ্বালানি তেলের সমপরিমাণ টাকা পান।
আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে একজন মন্ত্রী মাসে ১০ হাজার টাকা করে পান। আর প্রতিমন্ত্রী সাড়ে ৭ হাজার টাকা এবং উপমন্ত্রী পান ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া একজন এমপি আপ্যায়ন ভাতা হিসেবে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে পান। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা অসুস্থ হলে পুরো চিকিৎসা খরচ বহন করে সরকার। অন্যদিকে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার চিকিৎসা খরচের সমান সুবিধা পান এমপি ও তার পরিবার।
এদিকে নিজ এলাকার মসজিদ, মন্দির উন্নয়নসহ এলাকার মানুষের দাতব্য কাজে একজন মন্ত্রী বছরে পান ১০ লাখ টাকা। প্রতিমন্ত্রী সাড়ে ৭ লাখ ও উপমন্ত্রী পান ৫ লাখ টাকা করে। আর একজন এমপি পান বছরে ৫ লাখ টাকা। এর বাইরেও তারা নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে ১১টি কমিশন গঠন করে দেয়। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়সীমা মেনে গত ১৫ জানুয়ারি চারটি কমিশন তাদের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও প্রতিবেদন জমা দেয়। তাদের সুপারিশে নির্বাচন কমিশনের জনবল নিয়োগের জন্য আলাদা নির্বাচন সার্ভিস গঠন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এবং শপথ ভঙ্গ করলে তদন্ত সাপেক্ষে কমিশনারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের আইন বাতিল, কোনো নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের সেই নির্বাচন করাসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনে মন্ত্রী-এমপিদের সুযোগ-সুবিধা কমানোর সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘মন্ত্রী-এমপিদের অবাঞ্ছিত অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আর্থিক নানা সুবিধার পাশাপাশি শুল্কমুক্ত গাড়ি থেকে শুরু করে সরকারি প্লটও পান তারা। তারা গার্ড অব অনারও পেয়ে থাকেন, যা তাদের একেবারেই জমিদারে রূপান্তরিত করেছে। সেজন্য আমরা এসব বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছি।’