গবাদি পশু থেকে মানুষে ছড়ায় অ্যানথ্রাক্স। গ্রামগঞ্জে রোগটি অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ নামে পরিচিত, যা ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। অতীতে সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, টাঙ্গাইলসহ কয়েকটি জেলায় রোগটির সংক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি রংপুরের কয়েকটি উপজেলায় রোগটি শনাক্ত হয়েছে। তবে রংপুরের বাইরে অন্য কোনো জেলায় রোগটি এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় এরই মধ্যে রংপুরের অর্ধ লক্ষাধিক গবাদি পশুকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। গবাদি পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা সহজলভ্য এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি তেমন একটা নেই। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে অসুস্থ গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া জবাই বন্ধ করতে হবে। এসব পশুর মাংস স্পর্শ বা নাড়াচাড়া করার মাধ্যমেই এটি মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এমনকি অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে ঝুঁকি এড়াতে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, রংপুরের কয়েকটি উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্তের পর গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধিদল রংপুরের পীরগাছা এবং পারুল ইউনিয়নে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জনের নমুনা সংগ্রহ করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আটজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। জেলার দুই ইউনিয়নের ১২টি বাড়ির ফ্রিজ থেকে মাংসের নমুনায় অ্যানথ্রাক্স পাওয়া যায়। পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন—এ রকম ৩০ জনের অধিক রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষের অ্যানথ্রাক্স মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের অ্যানথ্রাক্স হয় পরিপাকতন্ত্রে, আরেক ধরনের অ্যানথ্রাক্স শরীরের বাইরের অংশে সংক্রমণ ঘটায়। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদি পশুর কাঁচা মাংস, শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সরাসরি সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ গবাদি পশু থেকে মানুষে ছড়ায়। তবে কোনো মানুষ আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে অন্য মানুষের দেহে সংক্রমিত হয় না। এ রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে শরীরের চামড়ায় ক্ষত বা ঘা সৃষ্টি হওয়া। মানুষের পরিপাকতন্ত্রে অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর সংক্রমণ হলে সাধারণত হালকা জ্বর, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে বাংলাদেশে যে অ্যানথ্রাক্স দেখা যায়, তা শরীরের বাইরের অংশে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের অ্যানথ্রাক্সে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোঁড়া বা গোটা হয়ে থাকে এবং চামড়ায় ক্ষত তৈরি হয়। এজন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগকে গরু-ছাগলের প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, অ্যানথ্রাক্স রোগে মৃত্যুঝুঁকি নেই। এ নিয়ে সচেতন হতে হবে। তিন মাস আগেই অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় ডেডিকেটেড টিম গঠন করা হয়েছে। কারও শরীরে উপসর্গ দেখা গেলে রোগটি শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। যারা অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছিলেন, তারা সবাই সুস্থ আছেন। এখন আর কোনো অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত রোগী হাসপাতালে নেই।
দুজনের মৃত্যু বিষয়ে তিনি বলেন, একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে যে রংপুরে অ্যানথ্রাক্সে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের দুজনের অটোপসি করেছি আইইডিসিআর ও রংপুর সিভিল সার্জন কার্যাললে। তারা কেউ অ্যানথ্রাক্সে মারা যাননি। তাদের চামড়ায় ঘা ছিল, কিন্তু মারা গেছেন হার্টের সমস্যা ও করোনায়।
আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, অ্যানথ্রাক্স নিয়ে তেমন কোনো আতঙ্ক নেই। সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর ও টাঙ্গাইলে বর্ষাকালে পানির নিচে থাকা ঘাস থেকে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত হওয়ার অতীতে রেকর্ড আছে। অ্যানথ্রাক্স প্রবণ এলাকায় বছরে একবার গবাদি পশুকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এবার রংপুরেও দেওয়া হচ্ছে।
মন্তব্য করুন