বিশ্বজুড়ে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে বেঁচে আছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দ্বিতীয় বৈশ্বিক উচ্চ রক্তচাপ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের সময় যৌথভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ ও রিসলভ টু সেভ লাইভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদরোগের চিকিৎসায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ও ডিমেনশিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য উভয়ই; কিন্তু জরুরি ব্যবস্থা না নিলে লাখ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করতে থাকবে এবং দেশগুলো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস বলেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণে প্রতি ঘণ্টায় স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য। রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, চলমান বিনিয়োগ এবং স্বাস্থ্যসেবাগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আমরা লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি।
ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ পাবলিক হেলথ প্রোগ্রামের নেতৃত্বদানকারী ড. কেলি হেনিং বলেন, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর ১ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। উচ্চ রক্তচাপের যত্নকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ এবং প্রাথমিক যত্নের সঙ্গে একীভূত করা দেশগুলোতে অগ্রগতি হতে শুরু করেছে। কিন্তু অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ এখনো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে রয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারণকারী শক্তিশালী নীতিমালা হৃদরোগ এবং প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু হ্রাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্থায়ী বাধা: প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৯৫টি দেশ এবং অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব দেশের মধ্যে ৯৯টি দেশ এবং অঞ্চলের জাতীয় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ২০ শতাংশের নিচে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে, যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়ন্ত্রিত।
প্রতিবেদনে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং দীর্ঘমেয়াদি যত্নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যবধান তুলে ধরা হয়েছে। মূল বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল স্বাস্থ্য প্রচার নীতি (অ্যালকোহল, তামাকজাত পণ্য ব্যবহার, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, লবণ এবং ট্রান্স ফ্যাট), বৈধ রক্তচাপ ডিভাইসের সীমিত উপযোগিতা, মানসম্মত চিকিৎসা প্রোটোকল এবং প্রশিক্ষিত প্রাথমিক চিকিৎসক দলের অভাব। এ ছাড়া ব্যয়বহুল ওষুধ, রোগীদের জন্য অপর্যাপ্ত আর্থিক সুরক্ষা এবং প্রবণতা পর্যবেক্ষণের জন্য অপর্যাপ্ত তথ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ওষুধের প্রাপ্যতা: রক্তচাপের ওষুধ সবচেয়ে ব্যয়বহুল জনস্বাস্থ্য সরঞ্জামগুলোর অন্যতম। নিম্ন আয়ের ২৫টি দেশের মধ্যে মাত্র সাতটি (২৮ শতাংশ) দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা সব ওষুধের সাধারণ প্রাপ্যতা রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ, কার্যকর, কম দামের ওষুধ থাকলেও অনেক মানুষ সেগুলো থেকে বঞ্চিত। ‘রেজলভ টু সেভ লাইভস’-এর প্রেসিডেন্ট এবং সিইও ড. টম ফ্রিডেন বলেন, এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারলে বাঁচবে অসংখ্য মূল্যবান জীবন এবং প্রতি বছর সাশ্রয় হবে বিলিয়ন ডলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাঁধা থাকলেও অগ্রগতি সম্ভব। বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে একীভূত করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে কিছু অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ১৫ শতাংশ থেকে ৫৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। এটাকে অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবা প্যাকেজে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত করে এবং স্ক্রিনিং এবং ফলো-আপ জোরদার করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধী ওষুধের জন্য কম খরচ এবং চিকিৎসা ফিস সীমিত করেছে, স্বাস্থ্য সংস্কারগুলোকে একীভূত করেছে, যার ফলে জাতীয়ভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে আসা ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করলে লাখ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমবে।
মন্তব্য করুন