চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রায় তিন যুগ পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে একের পর এক প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করছে। শিক্ষার্থীবান্ধব নানা প্রতিশ্রুতিতে ভরপুর এসব ইশতেহারে কেউ বলছেন, ভর্তির প্রথম দিনই হলে আবাসনের ব্যবস্থা করবেন। কেউ বলছেন ১০ শতাংশ আসন বৃদ্ধি করবেন, কেউবা আবাসন ভাতা ও নতুন হল নির্মাণের আশ্বাস দিচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন, মেডিকেল সেন্টারকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করবেন। শাটল ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি কেউ ডেমু ট্রেন সংস্কারের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক ও একাডেমিক নানা সংস্কারের ঘোষণাও দিচ্ছেন অনেকে।
তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন, এই প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, আর কতটুকুই কাগুজে অঙ্গীকার। কারণ, ইশতেহারে থাকা বেশকিছু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি, আবার এমন অনেক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা ছাত্র প্রতিনিধিদের এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে না। অলীক এমন অনেক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা শুধু ভোটার টানার কৌশলমাত্র, শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যার সমাধান নয়।
চাকসুর কাজ কী? : চাকসুর সংশোধিত গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট কার্যাবলির কথা উল্লেখ আছে। কাজগুলো হলো—চাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার, চাহিদা ও সমস্যা প্রশাসন এবং শিক্ষকদের কাছে তুলে ধরবে। এ ছাড়া চাকসুর দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, চাকসু বক্তৃতা, বিতর্ক, প্রবন্ধ, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, খেলাধুলা ও অন্যান্য সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম আয়োজন করবে। পাশাপাশি মানবিক ও সমাজসেবামূলক উদ্যোগ, রিডিং রুম ও কমন রুম পরিচালনা এবং প্রতি বছর অন্তত একটি স্টুডেন্ট জার্নাল প্রকাশ করাও চাকসুর দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে।
>> বড় বড় প্রতিশ্রুতি, সীমিত ক্ষমতা
ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বৈচিত্র্যের ঐক্য, অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য, সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য, বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য, সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদসহ প্রায় সব প্যানেলই তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে। প্রতিটি ইশতেহারেই উন্নয়ন, সংস্কার ও সেবা বাড়ানোর কথা বলা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী চাকসুর হাতে বড় কোনো বাজেট বা নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা নেই।
>> ছাত্রদলের ৮ দফা ইশতেহার
বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে আট দফা ইশতেহার ঘোষণা করে ছাত্রদল। ইশতেহারে বলা হয়, ভর্তির প্রথম দিনই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ‘একটি সিট, একটি পড়ার টেবিল’ নিশ্চিত করা হবে। পরিবহনে শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি সংযোজন, ই-কার ও বিশেষ বাস সার্ভিস চালু এবং ট্র্যাকিং অ্যাপ তৈরি করার ঘোষণা দেওয়া হয়। মেডিকেল সেন্টারকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীতকরণ, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা, ব্লাড ব্যাংক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদারের পরিকল্পনাও রয়েছে। অনলাইন স্টুডেন্ট পোর্টাল চালু, ম্যাটল্যাব ও গবেষণা সফটওয়্যারের ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা, শহরে গ্রন্থাগারের শাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সুইমিংপুল ও জিমনেশিয়াম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
শিবিরের ৩৩ দফা: ‘এক বছরে ৩৩ সংস্কার’ প্রতিশ্রুতি
ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ ঘোষণা করেছে ৩৩ দফা ইশতেহার। তারা এক বছরের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের ইশতেহারে আবাসন সংকট নিরসনে বিদ্যমান হলগুলো সংস্কার, নতুন টিনশেড নির্মাণ ও এক্সটেনশন ব্লক বাড়িয়ে অন্তত ১০ শতাংশ আসন বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থায় শাটল ট্রেনের বগি বাড়ানো, ট্র্যাকিং অ্যাপ চালু ও নগর থেকে দ্বিতীয় রেললাইন স্থাপন প্রকল্প ত্বরান্বিত করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। গবেষণার মানোন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি, গবেষণা বৃত্তি, রিসার্চ ফেস্ট আয়োজন, বিভাগীয় লাইব্রেরি আধুনিকায়ন এবং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রকে ৫০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
>> অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্যের ১৭ দফা
‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ১৭ দফার ইশতেহারে নিয়মিত চাকসু নির্বাচন, দলীয় আধিপত্য ও সহিংসতা বন্ধ, বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস, স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক সহায়তা নিশ্চিতকরণসহ নানা বিষয় স্থান পায়। এ ছাড়া তারা শাটল ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধি ও ডেমু ট্রেন পুনঃচালুকরণ, নতুন হল নির্মাণ, খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ, মাদকমুক্ত পরিবেশ, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা এবং নির্বাচিত হলে মাসিক জবাবদিহিমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের অঙ্গীকার করেছে।
>> বৈচিত্র্যের ঐক্যের ৮ দফা
বিভিন্ন বাম সংগঠনের ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেলে ৮ দফা ইশতেহারে নিরাপদ ক্যাম্পাস গঠন, আবাসন সমস্যা নিরসন, খাদ্য-স্বাস্থ্য-পরিবেশের উন্নয়ন, শিক্ষা ও গবেষণার প্রসার, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি, জাতিগত বৈচিত্র্য ও নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নির্মাণ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় স্থান পেয়েছে।
>> ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্যের সাত দফা
‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু, চবি মেডিকেলকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রূপান্তর, আবাসন খাতে স্বল্পমেয়াদে বাড়ি ভাড়া নিয়ে হোস্টেল চালু, দীর্ঘমেয়াদে নতুন হল নির্মাণ ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর এক হাজার শিক্ষার্থীকে আবাসন ভাতা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে।
>> সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ২৪ দফা
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিস সমর্থিত প্যানেল ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ২৪ দফা ইশতেহারে বলা হয়, প্রতিটি বিভাগে একাডেমিক উপস্থিতি ও পাঠদান তদারকিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবে, যা সরাসরি ছাত্র সংসদে প্রতিবেদন দেবে। শিক্ষক উপস্থিতি ও কোর্স কাভারেজ উন্মুক্ত বোর্ডে প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি প্রতি সেমিস্টারে ‘ওপেন সিলেবাস পর্যালোচনা সভা’ চালুর প্রস্তাব করা হয়। ‘স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়তে ‘একটি স্মার্ট কার্ড’ চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে গ্রন্থাগার, বাস, ক্যাফেটেরিয়া, প্রশাসনিক সেবাসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে। ফল দেখা, ফি প্রদান ও সনদপত্র আবেদনও হবে অনলাইনে।
>> সচেতন শিক্ষার্থী সংসদের ১২ বিভাগের ইশতেহার
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ সমর্থিত ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল ১২টি বিভাগে মোট ৯১টি উপদফা সংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ইশতেহারে ১১টি অঙ্গীকারের পাশাপাশি ১২ বিভাগের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
>> প্রতিশ্রুতির বাহার নিয়ে শিক্ষার্থীরা কী বলছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী কাইফ উদ্দীন হেমন্ত কালবেলাকে বলেন, আমি বেশ কয়েকটি প্যানেল ও প্রার্থীর ইশতেহার পড়ার চেষ্টা করেছি। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, প্রতিশ্রুতিগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক অনেক। অনেক প্রার্থীই জানেন না তাদের এখতিয়ার বা দায়িত্বের সীমা কোথায়। সবাই এমন সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যেগুলো বাস্তবে চাকসুর পক্ষে করা সম্ভব নয়।
পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী জিল্লুর রহমান বলেন, ‘চাকসু নির্বাচন ঘিরে অনেক প্রার্থীই যুগোপযোগী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। আবার অনেকের ইশতেহার পড়ে মনে হয়েছে তারা নিজদের কাজের পরিধিই জানে না। আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছে, যা কখনোই বাস্তবায়ন সম্ভব না। এক বছরের মধ্যে যেসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব প্রার্থীদের ইশতেহারে সেসবই থাকা উচিত ছিল।
বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সাজনিন কাউছার বলেন, এক প্যানেল বলছে মেডিকেল সেন্টার ১০০ শয্যায় উন্নীত করবে, আরেক প্যানেল বলছে শাটলে এসি, ওয়াইফাই দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দীর্ঘদিন চেষ্টা করে একটা বগি বাড়াতে পারে না, সেখানে তারা এসব কীভাবে করবে? ইশতেহারগুলো পড়লে মনে হয়, যেন তারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়—পুরো দেশের চিত্রটাই বদলে ফেলবেন। অথচ চাকসুর ক্ষমতা সীমিত, বাজেটও অল্প। তাই আমার মনে হয়, ইশতেহারগুলো আরও যৌক্তিক, বাস্তবভিত্তিক ও শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যানির্ভর হওয়া উচিত।
>> যা বলছেন চাকসুর সাবেক নেতা ও শিক্ষকরা:
চাকসুর সাবেক ভিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এস এম শামসুজ্জামান হীরা কালবেলাকে বলেন, ক্যাম্পাসে উন্নয়নমূলক কাজ করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ফান্ড দেবে সরকার; কিন্তু ইশতেহারে এসব অলীক বিষয় রাখা হয়েছে শুধু জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য। এটার কোনো সারবত্তা নেই। এসব কাজ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাজেট থাকতে পারে, তবে ছাত্র সংসদে বাজেট বা সক্ষমতা কোনোটিই নেই। এগুলো ভোটাদের আকর্ষণ করার জন্য হাওয়াই স্লোগান বা ইশতেহার, যার কোনো বাস্তবতা নেই। ছাত্র সংসদের কাজ হবে ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা, দাবি-দাওয়া প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা। প্রশাসন যতটুকু সম্ভব বাস্তবায়ন করবে।
একই ধরনের কথা বললেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আল আমীনও। তিনি বলেন, ছাত্র সংসদে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা তো ছাত্রই। বড় বড় কাজগুলো তারা কীভাবে করবে? তাদের একটা সুযোগ আছে, ছাত্রদের সমস্যাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রশাসনকে জানাতে পারবে। কাজগুলো ত্বরান্বিত করতে প্রয়াস চালাতে পারবে।
মন্তব্য করুন