জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে চার্জশিট নিরপরাধের কারাভোগ

জমির বিরোধ
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স।
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স।

জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিবেশীদের ঘায়েল করতে করা হয় মামলা। এজাহারে প্রতিবেশীর মারধরে গুরুতর জখম ও আঘাতের অভিযোগ আনা হয়। আদালত বাদীপক্ষের মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) তলব করেন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) কুমিল্লার তিতাস থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কাওসার আদালতে মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দেন।

এরপর আসামিরা আদালতে হাজির হতে গেলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে দীর্ঘ তদন্ত শেষে আসামিদের অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। চার্জশিটে তিনি বাদীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন বলে আদালতকে জানান। প্রমাণস্বরূপ তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মেডিকেল সার্টিফিকেটের উদ্ধৃতি দেন।

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মামলার আইও তিতাস থানার এসআই আবুল কাওসার আদালতে যে চারটি মেডিকেল সার্টিফিকেট দাখিল করেন, তার সবকটিই জাল বা নকল। ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কালবেলাকে জানিয়েছে, চারটি এমসিই ভুয়া। এসব এমসি ঢামেক হাসপাতাল থেকে ইস্যু করা হয়নি। এমনকি এমসিগুলো যে চিকিৎসকের নামে ইস্যু করা হয়েছে, ঢামেক হাসপাতালে ওই নামের কোনো চিকিৎসকই নেই।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাদীপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট আদালতে জমা দিয়েছেন। তবে কালবেলার প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কাওসার অনৈতিক কোনো সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, অপরাধ উদ্ঘাটনে গিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই অপরাধ করেছেন। তিনি ভুয়া বা জাল মেডিকেল সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করে আদালতকে মিসগাইড (ভুল পথে চালিত করা) করেছেন। এর ফলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাদিম মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি যে আদালতকে তিনি মিসগাইড করেছেন, সেই বিচারকও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে পুলিশ প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না দেখায়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিরোধের জেরে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার তিতাস থানায় মামলাটি করেন মো. লিটন নামে এক ব্যক্তি। যার এফআইআর নম্বর-১৩ ও জিআর মামলা নম্বর ৯৮/২০২৪। আসামি করা হয় মামলার বাদীর ৯ প্রতিবেশীকে। এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আসামিরা তাকে লাঠিসোটা, লোহার রড ও পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে নিলাফুলা জখম করেন। বাদীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় কোপ দিয়ে গুরুতর জখম করেন।’ এরপর আদালত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বাদীর মেডিকেল সার্টিফিকেট তলব করেন। তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কাওসার আদালতে তিনটি মেডিকেল সার্টিফিকেট দাখিল করেন। পরবর্তী তারিখে আসামিরা হাজির হতে গেলে ২ নম্বর আসামি ইমার আলী ওরফে ইমনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। পরে প্রায় চার মাস জেলে খেটে জামিনে বের হন তিনি। একইভাবে গত বছরের ২২ নভেম্বর একই থানায় আরও একটি মামলা করেন প্রথম মামলার বাদী লিটনের আপন চাচাতো ভাই সাকিব আহমেদ ওরফে মোহাম্মদ আলী। এই মামলায় আসামি করা হয় আটজন প্রতিবেশীকে। যার মধ্যে পাঁচজনই আগের মামলায়ও আসামি ছিলেন।

এজাহারে বলা হয়, ‘আসামিরা বাদীর পথ আটকে লাঠিসোটা, লোহার রড, লোহার পাইপ, ছুরি, চাপাতি, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। এরপর লোহার রড ও পাইপ দিয়ে বাদীকে মেরে গুরুতর জখম করেন। আসামিদের হাতে থাকা রামদা দিয়ে কোপ মেরে বাদীকে গুরুতর জখম করেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুটি মামলাতেই তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পুলিশ প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানিয়েছেন, অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা প্রমাণস্বরূপ আদালতে চারটি মেডিকেল সার্টিফিকেট দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে মেডিকেল সার্টিফিকেটের উদ্ধৃতি দিয়ে বাদীর অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

সেসব মেডিকেল সার্টিফিকেটের অনুলিপি সংগ্রহ করেছে কালবেলা। এগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে যে চারটি মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন, তার সবকটিই জাল বা নকল। এসব মেডিকেল সার্টিফিকেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি সার্টিফিকেটেও কোনো রেফারেন্স বা স্মারক নম্বর নেই। অথচ সরকারি যে কোনো নথিপত্রে স্মারক নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক।

এরপর এমসিগুলো যাচাই করতে খোঁজ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তথ্য অধিকার আইনে এমসিগুলো যাচাইয়ের আবেদন করলে লিখিতভাবে উত্তর দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গত ২৭ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘তথ্য প্রাপ্তির জন্য আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত মো. আলী, বয়স ২৫ বছর, রেজি. নং ৩৬৭/২৬৪৬৭; লিটন, বয়স ৪০ বছর, রেজি. নং ২০৩১১/১১; মো. রিপন, বয়স ৩৫ বছর, রেজি. নং ৯৫৪/১৯৯০৪ ও মমতা, বয়স ৫৫ বছর, রেজি. নং ১১২৯/১৭৬২৯ ব্যক্তিদের নামে দাখিলকৃত জখমি সনদগুলো অত্র হাসপাতাল থেকে ইস্যু করা হয়নি। বিষয়টি আপনাকে অবহিত করা হলো।’

কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ২২ নভেম্বর তিতাস থানায় যে অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, সেই জায়গায় ওই ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আসামিদের বেশ কয়েকজন সেদিন কুমিল্লাতেই ছিলেন না। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ করে যা নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাদীপক্ষ ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা দাবি করলেও ওই হাসপাতালে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি। ঢামেক হাসপাতালের রেজিস্টার যাচাই করে ২২ নভেম্বর তিতাসের ওই নামে কোনো রোগী ভর্তির তথ্য পাওয়া যায়নি।

এমসি সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, থানায় মামলা হলে তদন্ত কর্মকর্তা বাদীর হাসপাতালে ভর্তির টিকিট, প্রেসক্রিপশন ও স্মারক নম্বর যুক্ত করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে এমসির জন্য চিঠি লেখেন। এটা একটু সময়সাপেক্ষ। দুই মাস থেকে কখনো কখনো ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাকে হাতে হাতে বা ডাকযোগে মেডিকেল সার্টিফিকেট পাঠিয়ে থাকে।

আবেদন করলে থানায় অবশ্যই কোনো ফরওয়ার্ডিং ডকুমেন্ট থাকার কথা— এমন প্রশ্নে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অবশ্যই থাকবে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আছে। যদি তিনি ওটা মামলার ডকেটের সঙ্গে আদালতে পাঠিয়েও দেন, তাহলে অবশ্যই আদালতে মামলার ডকেটের সঙ্গে থাকবে। কোর্টের জিআরওকে তদন্ত কর্মকর্তা বললেই দিয়ে দেবে। এখানে ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ করা হয় তিতাস থানার তৎকালীন এসআই আবুল কাওসারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ডাকযোগে এমসি পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছি।’

চারটির একটি এমসিতেও স্মারক নম্বর না থাকা এবং যাচাই না করেই প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডাকযোগে পেলে আমরা সাধারণত সেটা যাচাই করি না।’

তাহলে তার কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো ফরওয়ার্ডিং বা ডাকের কোনো রিসিভ কপি অথবা কোনো ধরনের ডকুমেন্টস আছে কি না—জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এখন ওই থানায় নেই। আমার কাছে কোনো ডকুমেন্ট নেই। সব আদালতে জমা দিয়ে দিয়েছি।’ এরপর সময় দিয়ে কোনো ডকুমেন্ট থাকলে তা এই প্রতিবেদককে দেখাতে বলা হয়। তবে তিনি নিজে থেকে কোনো যোগাযোগ করেননি।

এর এক মাস পর গত ২৭ অক্টোবর ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে ফের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একই কথা বলেন। পরে আরও একদিন সময় দিয়ে আদালত থেকে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে দিতে বলা হয়। তবে গতকাল পর্যন্ত তিনি কোনো যোগাযোগ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালেদ সাইফুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘এমন একটি আবেদন কোর্ট থেকেও এসেছে। আমাদের পরিদর্শক (তদন্ত) বিষয়টির তদন্ত করছেন। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।’

এরপর তিতাস থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ডাকযোগে এমসি পেয়ে আমাদের এক আইও অভিযোগপত্র দিয়েছিল। পরে আসামিপক্ষ আদালতে দাবি করেছেন, এমসিগুলো নকল। আদালত বিষয়টি পুনঃতদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তদন্ত করছি, আমি ঢাকা মেডিকেলেও যাব। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।’

তদন্ত কর্মকর্তা যদি আবেদন করে থাকেন এবং তার পরে হাসপাতাল থেকে ডাকযোগে এমসি দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই থানায় তার ফরওয়ার্ডিং বা কোনো প্রমাণ থাকার কথা—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওটা তো কোর্টে দিয়ে দিয়েছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

ভিডিও ডাউনলোডের জন্য কিছু সহজ ও নির্ভরযোগ্য অ্যাপ

১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ‘ড্র’ রোববার

দেশ ও জাতি নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে : ড. জালাল

আবারও বাংলাদেশে আসছে পাকিস্তানি ব্যান্ড ‘কাবিশ’

স্বাস্থ্য, ত্বক ও ঘরের যত্নে ছোট্ট জাদু ‘আদা’

একটি রাজনৈতিক দল জান্নাতের টিকিট বিক্রি করছে : ব্যারিস্টার খোকন

আজ ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়

১০ নভেম্বর পর্যন্ত আবেদন করুন ব্র্যাক ব্যাংকে

তছনছ করে দুর্বল হলো ঘূর্ণিঝড় মেলিসা

১০

সিরিয়ার ওপর সিজার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১১

প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ দিচ্ছে ব্র্যাক

১২

ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দেবে পেন্টাগন

১৩

অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্স

১৪

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১৫

দেশের ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাতিল হবে : মান্নান

১৬

ঢাকায় কখন হতে পারে বৃষ্টি, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৭

শনিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৮

০১ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

কুবি ছাত্র সংসদ নির্বাচন / অনাবাসিকদের প্রার্থিতা ও ভোটাধিকার নিয়ে বিতর্ক

২০
X