টাকার বিনিময়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করে বয়স কমিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি, আবার কখনো ভর্তি ছাড়াই কথিত শিক্ষার্থীরা পেত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সুযোগ। এ ছাড়া পরীক্ষায় পাস করানোর দায়িত্বও নিত তারা। এমন অভিযোগ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এক প্রকৌশলীসহ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বোর্ডের কর্মকর্তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসাধু শিক্ষকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রটি এ ধরনের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত দীর্ঘদিন। আর এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
চক্রটির মূলহোতা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী মোহাম্মদ সামসুল আলম। তার বিরুদ্ধে সরকারি কাগজপত্র ও পরীক্ষার ফল জালিয়াতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপপরিচালক কমলেশ মণ্ডলকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
দুদকের তথ্যমতে, গত বছরের শেষদিকে সামসুল আলমের বিরুদ্ধে নানা জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে।
অনুসন্ধান এ-সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে গত ২৭ এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠান তদন্ত কর্মকর্তা কমলেশ মণ্ডল। চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে সামসুল আলম, তার স্ত্রী সিরাজুম মুনিরা ও দুই সন্তানের নামে কোনো ফ্ল্যাট, প্লট, জমিসহ অন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকলে সেগুলোর তথ্য পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়।
দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়, কারিগরি বোর্ড এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির শক্তিশালী একটি চক্র। চক্রটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ছাড়াই যে কাউকে ছাত্র বানিয়ে দিচ্ছে। আবার পরীক্ষায় অংশ না নিলেও পাস করিয়ে দিচ্ছে। খাতা মূল্যায়ন না করিয়ে নম্বর দিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও আছে। এমনকি মাঝপথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জায়গায় নতুন নাম ঢুকিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন সেমিস্টারে ফেল করা পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিয়েছে চক্রটি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সরাসরি এসএসসি (ভোকেশনাল ও দাখিল) এবং এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার মূল কাজটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা করেন। এ কাজে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আর সরাসরি ডিপ্লোমা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে প্রতিজনের কাছে থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সেখান থেকে বোর্ডের কর্মকর্তা পান ৩০ হাজার টাকা।
অভিযোগে মতে, নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় সব সিট ফিলাপ করে রাখেন অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। ফাইনাল পরীক্ষার আগ মুহূর্তে কিছু শিক্ষার্থী সরাসরি নবম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দিতে আসে। তাদের থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়ে নাম রিপ্লেস হয়। বোর্ডের কর্মকর্তারা পান ৭ হাজার টাকা করে। আর এসএসসি, এইচএসসি এবং বিভিন্ন ডিপ্লোমা পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে না পারা শিক্ষার্থীদের থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে প্রবেশপত্র দেয়ার বাণিজ্য করে। এই কাজে বোর্ডের সিন্ডিকেট নেয় ৫ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া এসএসসি, এইচএসসি কিংবা ডিপ্লোমা পরীক্ষায় কোনোমতেই পাস করতে পারবে না বলে বিশ্বাস এমন ছাত্রছাত্রীকেও পাস করানোর অভিযোগ আছে।
অভিযোগ রয়েছে, হারিয়ে যাওয়া অ্যাডমিট বা রেজিস্ট্রেশন কার্ড ডুপ্লিকেট পেতে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে নির্দিষ্ট ফরমেটে আবেদন না করে কম্পিউটার শাখা থেকে সরাসরি প্রিন্ট করে দেওয়া হয়। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বোর্ড।
অভিযোগে বলা হয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে এই অনিয়ম। নিয়ম অনুযায়ী, যেসব ছাত্রছাত্রী জেএসসি পাস করেনি তারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলে জন্মতারিখ ১৯৯৭ সালের পর হতে পারবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ১৯৯৭ সাল দিয়ে অনলাইনে ভর্তি করে। পরে বয়স কমিয়ে নেন। এ দুর্নীতি করেও বছরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় জালিয়াত চক্রটি।
যে চক্রটি ভুয়া শিক্ষার্থীদের এসএসসি বা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করানোর অনিয়ম করছে তার সঙ্গে বোর্ডের কম্পিউটার সেল এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। তবে অধিকাংশ সদস্যই শিক্ষক। এ ছাড়া কম্পিউটার সেলের এক কর্মকর্তার স্ত্রীও চক্রের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বলে তথ্য আছে।
মন্তব্য করুন