এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শতভাগ ফেল করেছে—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪২টি। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে গত বছরও শতভাগ ফেল করেছে, এবারও তাই। শতভাগ ফেল করেছে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই নন-এমপিও। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ জনেরও কম। তবুও নামকাওয়াস্তে চলছে কলেজগুলো, দেখার কেউ নেই।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে গত রোববার। এ বছর ৯ হাজার ১৮৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেন। গত বছর শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০। এবার শূন্য পাস ৪২ কলেজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে, ১৬টি। এ ছাড়া যশোরে সাতটি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পাঁচটি, রাজশাহীতে চারটি, ময়মনসিংহে চারটি, চট্টগ্রামে তিনটি ও কুমিল্লায় একটি কলেজ থেকে কেউ পাস করতে পারেননি। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুটি মাদ্রাসাও রয়েছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৫টিতে পরীক্ষার্থী ছিলেন একজন করে। একটিতে সর্বোচ্চ ২১ জন, আরেকটিতে ছিলেন ১৯ জন পরীক্ষার্থী।
শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ঢাকার এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ। রাজধানীর সবুজবাগে অবস্থিত কলেজটি। এবার ওই কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ফেল করেন। প্রতিষ্ঠানটির ভবনে ‘এশিয়ান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’, ‘এশিয়ান আইডিয়াল স্কুল’ ও ‘এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ’ নামে তিনটি সাইনবোর্ড দেখা গেছে। অবশ্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তালিকায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা রয়েছে ‘এশিয়ান আইডিয়াল কলেজ’।
এই কলেজের অধ্যক্ষ নেসার আলী কালবেলাকে বলেন, দ্বৈবচয়নে আবেদন করে শিক্ষার্থীরা এই কলেজ পেয়েছে। এরপর মাত্র দুজন মেয়ে ভর্তি হয়। একজন পরীক্ষার আগেই বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন। আরেকজনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। তবে তিনি পরীক্ষা দিয়েছেন। আইসিটি পরীক্ষার দিন তার বাচ্চা হয়েছে। যে কারণে সেই বিষয়ে তার ফেল এসেছে। মাঝে একাডেমিক স্বীকৃতি-সংক্রান্ত অসুবিধার কারণে কিছুটা সমস্যা হলেও বর্তমানে সমস্যাটি কেটে গেছে বলে জানান অধ্যক্ষ।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন শূন্য পাস করা পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি নর্দার্ন কলেজ, বাংলাদেশ। কলেজটি আগে মোহাম্মদপুরের আসাদগেটে ছিল। ২০১৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে স্থানান্তর করা হয়। এ বছর এই কলেজ থেকে একজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পাস করেননি।
জানতে চাইলে কলেজটির অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থী কমে যায়। এরপর ঠিকমতো প্রচার করতে পারিনি। যে কারণে শিক্ষার্থী মাত্র একজন। সেও ফেল করেছে। তবে চেষ্টা করছি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে।
গত বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আটটি প্রতিষ্ঠান ছিল শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। এর একটি গোপালগঞ্জ সদরের পাইককান্দি ইউনিয়নের ডা. দেলোয়ার হোসাইন মেমোরিয়াল কলেজ। গত বছর এই কলেজ থেকে চার শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই ফেল করেন। এবারও অংশ নেওয়া পাঁচজনই অকৃতকার্য। এমন আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছে কালবেলা। দুটিই দিনাজপুর বোর্ডের। এর একটি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার দুহুলী এস সি উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ। গত বছর চারজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেন। এ বছর এই প্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে তিনি অকৃতকার্য হন। আরেকটি দিনাজপুরের ফুলবাড়ির উত্তর লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এই কলেজ থেকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে একজন এবং চলতি বছর একজন করে পরীক্ষায় অংশ নিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
জানতে চাইলে উত্তর লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজটি নন-এমপিও। যে কারণে বিনা বেতনে শিক্ষকরা ক্লাস করাতে আগ্রহী নন। এজন্য ফল এমন খারাপ।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার ন্যাশনাল পাবলিক কলেজে এবার ২১ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও সবাই ফেল করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির সহকারী প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় কম। যারা ভর্তি হয়, তারাও ঠিকমতো ক্লাসে আসে না। সাধ্যমতো চেষ্টা করি, তারপরও পারি না।
নেত্রকোনার খলিশাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর ১৯ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই ফেল করেছেন। জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বলেন, আমাদের কলেজ শাখা নন-এমপিও। তিনজন নিয়মিত ও দুজন খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে চলছে। শিক্ষার্থীরা এসএসসিতে অটো পাস পাওয়ায় ঠিকমতো ক্লাসে আসত না। এ বছর ৪০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল একাদশ শ্রেণিতে। তবে নির্বাচনী পরীক্ষায় ১০ জন পাস করে। বাকি ৯ জনকেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই ফেল করল। এর আগে গত বছর চারজনে একজন এবং তার আগের বছর ১২ জনে ছয়জন পাস করেছিল। চেষ্টা করছি কীভাবে ভালো করা যায়।
রাজশাহীর তানোরের মুণ্ডুমালা গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেন। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাদিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান। যে কারণে শিক্ষকরা ঠিকমতো বেতন পান না। করোনার পরে কিছুদিন অধ্যক্ষ চালিয়েছেন। তবে এখন কলেজে ক্লাস বন্ধ।
এবার শূন্য পাস করা কলেজগুলোর মধ্যে সাতটিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেগুলোতে শিক্ষার্থী একেবারেই কম। পড়াশোনা তেমন হয় না। শিক্ষক সংকটও চরমে। কলেজগুলো চলছে মূলত নামকাওয়াস্তে। শিক্ষা বোর্ড ও কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি রয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কোনোরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে এমপিওভুক্তির আশায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কেমন পড়াশোনা হয়, তার কোনো কার্যকর তদারকি করে না শিক্ষা বিভাগ।
গত বছরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি ফেল করা প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর বোর্ডে। আবার এই বোর্ডেরই দুটি প্রতিষ্ঠান গত বছর এবং চলতি বছর শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক স. ম. আব্দুস সামাদ আজাদ কালবেলাকে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আমরা তাদের ডেকে পাঠাব, এরপর দেখি কী করা যায়।
এবার শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, এর আগে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানকে ডেকে পাঠিয়েছি। এবার সে কারণে আগের প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকায় নেই। একটি কলেজ রয়েছে জানালে তিনি বলেন, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাবছি পরবর্তী সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাতিল করা হবে।