দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা পার হতে পারে বলে গতকাল মঙ্গলবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমে উন্নতির দিকে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
গত কদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা, কুশিয়ারা ও রক্তি নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এতে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, মধ্যনগরসহ ছয় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। নদনদীর পানি বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে নেত্রকোনাতেও।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদনদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব প্রধান নদনদীর পানি কমছে। পানি কমার এ ধারাও আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির ক্রম-উন্নতি হতে পারে।
তিনি আরও জানান, উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি সময় বিশেষে বাড়তে পারে। এতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে সাময়িকভাবে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
গতকাল সকাল ৯টার তথ্য তুলে ধরে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার, সোমেশ্বরী নদীর পানি কমলাকান্দায় ৩০ সেন্টিমিটার ও পুরোনো দেরাই নদীর পানি দেরাই পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে সব নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৮৬ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩০৭ মিলিমিটারের বেশি। তবে সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসেন জানিয়েছেন, সিলেটে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত চার দিনে সুনামগঞ্জে ৬৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার সারা দিনই রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ছিল। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত কমায় সুনামগঞ্জে ছয়টি স্টেশনের মধ্যে পাঁচটি স্টেশনেই নদীর পানি কমেছে। পানি না বাড়লেও জেলার দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের যোগাযোগ সড়ক ও বাড়ির আঙিনায় এবং কিছু ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় দুর্ভোগে আছেন এসব এলাকার মানুষ। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে নিম্নাঞ্চলের ৪১ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের শক্তিয়ারখলা ১০০ মিটার ব্রিজের পাশের সড়ক এখনো ডুবে থাকায় যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
রংপুর ব্যুরো জানায়, এক দিনের ব্যবধানে পানি কমতে শুরু করেছে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদীতে। এসব নদীতে কখনো পানি বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। পানির এমন কমা-বাড়ার খেলায় ভাঙন চিন্তায় পড়েছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। তারা জানান, নদীতে পানি বাড়ার পর যখন কমতে শুরু করে তখনই ভাঙন শুরু হয়। এবার দুই দফায় পানি কিছুটা বাড়লেও আবার কমেছে। এখন যে কোনো সময় ভাঙন দেখা দিতে পারে।
গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হাদী জানান, পানি বাড়লেও বিপৎসীমার নিচেই ছিল। এখনো ভাঙন শুরু হয়নি। তবে আগাম প্রস্তুতি নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব জানান, এই অঞ্চলের নদনদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কোথাও তীব্র ভাঙনের খবর আসেনি। ভাঙন দেখা দিলে অবশ্যই তাৎক্ষণিক সমাধান করার চেষ্টা করা হবে।
হাতীবান্ধা ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিস্তা পাড়ের মানুষজন বন্যার আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থায় পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন বলেন, আমরা সবসময় নদীপাড়ের লোকজনের খোঁজখবর নিচ্ছি। তাদের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।
পানির অব্যাহত ওঠা-নামায় জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, ফকিরপাড়া ইউপির রমণীগঞ্জ, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চরবৈরাতিসহ পার্শ্ববর্তী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। কোথাও কোথাও পানিতে ডুবে আছে রাস্তাঘাট। তলিয়ে গেছে বাদাম, আমন বীজতলা ও সবজি ক্ষেত।
এদিকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি কমলেও এখনো নিম্নাঞ্চলের কিছু বাড়িঘর পানিবন্দি রয়েছে। তলিয়ে রয়েছে বাদাম, আমন বীজতলা ও সবজি ক্ষেত আর রাস্তাঘাট। যেখান থেকে পানি নেমে গেছে, সে এলাকাগুলোও রয়েছে কর্দমাক্ত। ফলে চলাচলে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার আনন্দবাজার তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা করিমন বেগম বলেন, ঘরের পানি নেমে গেছে। ভিজে আছে রান্না ঘরের চুলা। পুরো বাড়িতে কাদা। চলাচল করতে কষ্ট হচ্ছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, পানি আবারও কমতে শুরু করেছে। ঈদের আগে ও পরে জেলার বন্যা কবলিত ইউনিয়নগুলোতে ৩০০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আরও চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলার নদনদীগুলোতে পানি আবারও বাড়ছে। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে নদীভাঙন। দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী এলাকার মানুষজন। গত দুই সপ্তাহে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙা ইউনিয়নের গোরকমণ্ডপ গ্রামের প্রায় শতাধিক বাড়িভিটা নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে শতাধিক পরিবারের। অনেকে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন অন্য জায়গায়। কেউবা সব হারিয়ে ঠাঁই নিচ্ছেন সরকারি বাঁধ কিংবা অন্যের জমিতে।
নাওডাঙা ইউনিয়নের গোরকমণ্ডপ এলাকায় রয়েছে দুটি মাদ্রাসা, স্কুল ও দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি মুজিব কেল্লা। এই মুজিব কেল্লায় বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা রয়েছে। অথচ খামখেয়ালিপনার কারণে উপজেলা যাওয়ার একমাত্র বাঁধটি ভেঙে যেতে বসেছে। এ অবস্থায় দ্রুত ভাঙন রক্ষার ব্যবস্থা না নিলে বিলীন হয়ে যাবে সব স্থাপনা। তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়েছে উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নসহ রাজারহাটের ঘড়িয়াল ডাঙার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক বসতবাড়ি।
চর মুন্সিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বকর আলী বলেন, ধরলা নদী যে হারে ভাঙছে, দু-এক দিনের মধ্যে গোরকমণ্ডপ হারিয়ে যাবে। চর গোরকমণ্ডপ এলাকার বাসিন্দা আজিজুল হক বলেন, এক মাসে গ্রামের ১৫০টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চলাচলের একমাত্র বাঁধটিও বিলীনের পথে। বাঁধটি ছিঁড়ে গেলে এ অঞ্চলের ৮ থেকে ১০টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল আহাদ বলেন, খুব ইচ্ছে ছিল বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে আজীবন থাকব; কিন্তু ধরলার ভাঙন সেই আশা শেষ করে দিল। ভিটেমাটি নদীতে চলে গেছে। উপায় না পেয়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছি। জানি না কপালে কী আছে।
নাওডাঙা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসেন আলী বলেন, চর গোরকমণ্ডপ বাঁধটি অর্ধেক নদীতে চলে গেছে। গ্রামটির প্রায় দুইশ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। এ ছাড়া হুমকির মুখে আছে হাজারো পরিবার।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, চরগোরকমণ্ডল এলাকায় ধরলা নদীর বাঁ তীরে ভাঙন কবলিত হচ্ছে। আমরা নজরদারিতে রেখেছি। এ ছাড়া জেলায় ২৬টি পয়েন্টে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অতিভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।
মন্তব্য করুন