উদ্ভট সব যুক্তি তৈরি করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে চার মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেলের ১৫২ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের সদ্য বিদায়ী কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী। তার এই কাজকে বেআইনি বলেছে এনবিআর গঠিত তদন্ত কমিটি। বেআইনিভাবে চার কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার কারণে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে অভ্যন্তরীণ চিঠিও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ১৬টি নথির বিপরীতে সুদ পুনর্গণনার সুপারিশও করেছে তদন্ত কমিটি।
এনবিআর সূত্র জানায়, সদ্য বিদায়ী কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী বেআইনিভাবে বাংলালিংকের ৯১ কোটি, গ্রামীণফোনের ৫২ কোটি, রবির ২০ কোটি এবং এয়ারটেলের ১৬ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছেন। বিষয়টি এনবিআরের নজরে আসার পর এ নিয়ে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় কাস্টম নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত এনবিআর সদস্য হোসেন আহমদকে। আর সদস্য করা হয় ভ্যাট, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ এবং ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার আবুল বাসার মো. শফিকুর রহমানকে। এই কমিটি বিষয়টি তদন্ত করে ভ্যাট মওকুফ করা আইনসিদ্ধ হয়নি বলে মতামত দিয়েছে। কমিটি প্রতিটি নথি পর্যালোচনার পাশাপাশি ভ্যাট আইনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আইনের ধারাসহ সার্বিক বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের সুদ আদায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এর আগে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কিছু সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সুদ আদায়ের বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। কিন্তু চার মোবাইল অপারেটরের মামলার সিদ্ধান্তে সুদের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। আর এ ক্ষেত্রে সুদ প্রযোজ্য হবে কি হবে না, সেটাও আইনের মৌলিক কাঠামোর ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিষয়। তাই সুদ প্রযোজ্য হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত দেওয়াও এলটিইউর তৎকালীন কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি।
এ ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় আইনের বিধান সম্পূর্ণরূপে পালন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে, নাকি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ যে কোনো সমঝোতায় আসতে পারেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় তদন্ত কমিটিতে। মূল্য সংযোজন কর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধামালা-২০১২ এর বিধিতে ৩(৭) বলা আছে, এডিআর নিষ্পত্তি হবে আইনের ধারা ৪১ক হতে ৪১ট এবং বিধিমালা অনুযায়ী। আর এডিআরের বিষয়টি ধারা ৪১(গ) এর অধীন নিষ্পত্তিযোগ্য নয়, তাহলে আবেদন ফেরত দিতে হবে। এ ছাড়া উভয় পক্ষ একমত হলেও নিষ্পত্তি আইনসংগত না হলে সমঝোতা করা যাবে না বলেও মতামত দিয়েছে তদন্ত কমিটি।
জানতে চাইলে এলটিইউ ভ্যাটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া কালবেলাকে বলেন, চার মোবাইল কোম্পানির সুদ আদায় সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। এনবিআরের সেই চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে এলটিইউর পক্ষ থেকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চার মোবাইল অপারেটরদের মামলার বিষয়টি ছিল স্থান এবং স্থাপনার ওপর সেবাগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাট ফাঁকি সংশ্লিষ্ট। আর ঘটনাটি ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হওয়ায় ভ্যাট আইন ১৯৯১ অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে। এতে এডিআর বিধিমালার ৪১ক থেকে ট ধারা অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে। এই আইনে কোনো প্রতিষ্ঠান এই কর আদায়ে ব্যর্থ হলে মাসিক ২ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। আর যে তারিখে প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিতে ব্যর্থ হবে সেদিন থেকে জরিমানার দিন গণনা করা হবে। আর মতামতের বিষয়ে তদন্ত কমিটি এই ১৬ মামলার বিপরীতে সুদ আদায়ের সুপারিশ করেছে। তবে এই অর্থ এখনো আদায় করা সম্ভব বলেও মনে করে কমিটি।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যক্রম শুরু করেছে মূসক বাস্তবায়ন বিভাগ। ইতোমধ্যে এলটিইউ ভ্যাটের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী কর্তৃক ১৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা মওকুফের ভ্যাট আদায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে এলটিইউ ভ্যাটকে চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে বিশাল অঙ্কের এই রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রম গ্রহণ করে এনবিআরকে জানাতেও বলা হয়েছে ওই চিঠিতে।