পাথরের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের বিশাল ভান্ডার। জ্যাঁ শ্যাপিলিয়ান নামে এক ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক রোসেটা স্টোনে থাকা হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করে মিশরের প্রাচীন ইতিহাস জানার জানালা খুলে দিয়েছিলেন। তাকে বলা হয় ইজিপ্টলজি বা মিশরীয় পুরাতত্ত্বের জনক। পাথরে খোদাই করা ফলকই শুধু নয়, একটি সাধারণ পাথর বিশ্লেষণ করেও জানা যায় একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বা তার ভূগঠন। পঞ্চগড়ে এমনই অসংখ্য পাথর নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র পাথর জাদুঘর বা রকস মিউজিয়াম।
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে ১৯৯৭ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ জাদুঘরটি গড়ে তোলেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক। জাদুঘরে বিভিন্ন রং, আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পাথর সংরক্ষিত আছে। হাজার বছরের পুরোনো পাথর ছাড়াও এখানে প্রাচীন ইমারতের ইট এবং পোড়ামাটির বিভিন্ন মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। জাদুঘরের জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালায় রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। উন্মুক্তভাবে এখানে বেশকিছু বড় পাথর এবং একটি শালগাছ দিয়ে তৈরি ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের ৩০০ বছর পুরোনো দুটি নৌকা রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে হিমালয়ের কাছের জেলা পঞ্চগড়। এখানকার ভূভাগে রয়েছে প্রচুর নুড়ি পাথর। ভূগর্ভের নুড়ি পাথরের কালানুক্রমিক কিছু নমুনা নিয়ে প্রথমে জাদুঘরটি গড়ে তোলেন পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক। এ অঞ্চলের ভূখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূমি-বৈশিষ্ট্য, প্রাগৈতিহাসিক নমুনা সংগ্রহ, নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণার জন্য জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ ও উন্মুক্ত দুই রকমের গ্যালারি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শিলা, পাললিক শীলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালু, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালু, খনিজ বালু, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শীলা। এ গ্যালারিতে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও রয়েছে। এখানে রয়েছে পঞ্চগড়ের আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং নদীর নিচে ও ভূগর্ভে প্রাপ্ত অশ্মীভূত কাঠ, তিনশ থেকে দুই হাজার বছরের পুরোনো ইমারতের ইটপাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাইট, ব্যাসল্ট, শেল, মার্বেল, বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে পাথর, নকশা করা অলংকৃত খিলান ও বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙের কাদা।
জাদুঘরে রয়েছে দুটি নৌকা। একটি শালগাছ কেটে বিশাল আকারের নৌকা দুটি তৈরি করা হয়েছে। নৌকার দৈর্ঘ্য ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর বয়স প্রায় তিনশ বছর। এ ধরনের নৌকা প্রাচীনকালের মানুষেরা প্রশান্ত মহাসাগরের দীপপুঞ্জে ব্যবহার করত বলে জানা যায়। একটি স্থানের নামেই ছিল ‘পাথর ঠাকুর’। এখানে রয়েছে পাথরে খোদিত ‘তীর-ধনুক’ ও দেবীর চোখের চিত্র। একটিতে রয়েছে তিব্বতি, চায়নিজ বর্ণমালা। একটি পাঁচ ফুট লম্বা কোয়ার্জাইট পাথর স্থাপিত হয়েছিল সম্ভবত কোনো সমাধিক্ষেত্রে।
পাথরগুলোর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, পার্শ্ববর্তী দার্জিলিংয়ের সমকালে পঞ্চগড় অঞ্চলেও নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ ভালোভাবেই বিস্তার ছিল। অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলে পঞ্চগড় জেলায় হয়তো প্রস্তর যুগের অনেক প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হতে পারে। আদি ঐতিহ্যের প্রাচীন ইতিহাসকে জীবিত রাখতে দেশের দুর্লভ এই মিউজিয়ামটিকে সংরক্ষণের তাগিদ দেন তারা। এই রকস মিউজিয়ামটি জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বহন করছে বলে জানান পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান।