মাওলানা আব্দুর রহমান
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজে শান্তি বজায় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা

সমাজে শান্তি বজায় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা

মানুষের সমাজে নানা গোষ্ঠী ও দলমত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের অনেক জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত, যে তোমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান, আল্লাহতায়ালা সর্বজ্ঞাত ও সর্ববিষয়ে অবগত।’ (সুরা হুজুরাত: ১৩)। এ আয়াত থেকে এটাও বুঝে আসে, বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের সমাজে সেই উত্তম যে তাকওয়া অবলম্বন করবে। এজন্য ইসলাম সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে ব্যক্তিজীবন সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। পাশাপাশি সবাইকে অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কেউ অপরাধপ্রবণ বা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার জন্য পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তির বিধান দিয়েছে। শুধু আইন ও বিধান দিয়ে সবক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। কারণ, আইন প্রয়োগের রয়েছে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অন্যদিকে আইনে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফাঁকফোকর। তাই ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন ও শাস্তির বিধানের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যা মানবীয় সহজাত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ। ইসলাম অপরাধী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পার্থিব শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা দ্রুত কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলামে কোনো অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, এমনকি খুনির শাস্তি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রাখা হয়নি। কারণ এতে অপরাধীদের ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অপকর্ম করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এজন্য মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দেব।’ (বোখারি: ৩২৮৮)

সমাজের সব মানুষের মধ্যে পরকালীন জবাবদিহির ভয় সৃষ্টি করতে হবে। দুনিয়াতে অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক, আখিরাতে সব অপরাধের বিচার হবে—এ মানসিকতা জনসাধারণের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন দ্বারা অপরাধ দমন করা যায়। সবাইকে অবহিত করতে হবে যে, দুনিয়ায় মানুষের চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখিরাতে আল্লাহর দরবারে সব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে দুর্নীতি, ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং পরিণামে জাহান্নামের মারাত্মক আজাবের সম্মুখীন হতে হবে, যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। সেদিন হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহতায়ালার ইরশাদ, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে। (সুরা ইয়াসিন: ৬৫)। আল্লাহর সামনে হিসাব দিতেই হবে, এ মানসিকতা জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হলে দুর্নীতি ও অপরাধ বন্ধ হবে। সৎ ও যোগ্য লোক গঠনের জন্য আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এজন্য প্রথমেই পারিবারিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারণ একজন শিশুর ওপর পারিবারিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তানই প্রবৃত্তির ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতামাতাই তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান বানায় অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়।’ (বোখারি: ১২৯২)। তাই প্রত্যেক পিতামাতার উচিত নিজেদের সন্তানকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার সুব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তা হচ্ছে সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষার সম্পূরক অধ্যায় চালু করা। যেমন মালয়েশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক ইসলামী শিক্ষা চালু রয়েছে এবং এর সুফলও তারা পাচ্ছে।

শান্তিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনের লক্ষ্যে ইসলামী মূল্যবোধ এবং তাকওয়ার ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন। ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। যে জাতি ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, যাদের তাকওয়া ও আখিরাতে জবাবদিহির বালাই নেই সে সমাজে দুর্নীতি সহজেই প্রবেশ করে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অপরাধ ও অনৈতিকতা। কিন্তু তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠিত হলে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আল্লাহর রহমত ও বরকতের দুয়ার খুলে যাবে। আল্লাহতায়ালার ইরশাদ, ‘লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ইমান আনত ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম।’ (সুরা আরাফ: ৯৬)। তাই জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ জনগণকে আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সততা ও নৈতিকতার আদর্শে উজ্জীবিত করতে হবে। মানুষের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সমাজ। সবাই যদি ব্যক্তিজীবনে হালাল-হারামের প্রতি সচেতন থাকে, তাহলে কমে যাবে অনেক অপরাধ। ইসলাম হালাল-হারাম তথা পবিত্র-অপবিত্রের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। সেইসঙ্গে হালালের কল্যাণ ও উপকারিতা এবং হারামের অপকারিতা ও ক্ষতি স্পষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহতায়ালার বাণী, ‘হে মানবমণ্ডলী, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ (সুরা বাকারা: ১৬৮)। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস কোরো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের কাছে পেশ কোরো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওই শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত হয়েছে।’ (কানজুল উম্মাল: ৯২৭৩)

সুন্দর সমাজ গঠনে সৎকর্ম সম্পাদন ও সৎকাজে উৎসাহ প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। কারণ সবাই যখন সৎকাজে উদ্যোগী হবে, দুর্নীতিবাজরা নিজে থেকেই নিস্তেজ হয়ে দুর্নীতি করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এতে সমাজ হবে দুর্নীতিমুক্ত। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৎকাজের প্রতি উৎসাহিত করতে গিয়ে বলেন, ‘মুমিন পুরুষ কিংবা নারী যে কেউ সৎকর্ম করবে আমি তাকে পবিত্র জীবন দেব এবং তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (সুরা নাহাল: ৯৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০) সর্বোপরি অপরাধ ও দুর্নীতির প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে। যদি সে এতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে। (মুসলিম: ১৮৬)।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্যানেলে তন্বির জন্য পদ শূন্য রাখলেও একই পদে লড়ছেন বাগছাসের এক নেতা

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের শেষ দুই ম্যাচের জন্য আর্জেন্টিনা দল ঘোষণা

আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক জোট

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ : এনামুল হক চৌধুরী

জিপিএ ৫ পেয়েও দ্বিতীয় ধাপে কলেজ পায়নি ১৪১৮ জন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বড় রদবদল

রাজশাহীর প্রবীণ সংবাদপত্র এজেন্ট হেকমত উল্লাহ মারা গেছেন

রোডম্যাপ কার্যকরের আগে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে : খেলাফত মজলিস

ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ

দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষার্থী পায়নি ৪১৩ কলেজ

১০

রাকসু নির্বাচন / ২৫ পদে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করল ছাত্রদল

১১

মতবিনিময় সভা করেছেন মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী

১২

কর্ণফুলী টানেলে ফের ৩ দিনের ট্র্যাফিক ডাইভারশন

১৩

তিন দলের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠক

১৪

তরুণদের আকাঙ্ক্ষার বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তুলবে বিএনপি : তেনজিং 

১৫

গাজার দুর্ভিক্ষকে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ বললেন হাল্ক

১৬

‘জুলাই সনদের আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল’

১৭

শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুললে দেশের উন্নয়ন হবে : মেয়র শাহাদাত

১৮

কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু অক্টোবরে

১৯

শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বুয়েট শিক্ষক সমিতির নিন্দা

২০
X