বাংলাদেশে প্রতিদিন দুইশ শিশুর জন্ম হয় ত্রুটিযুক্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে। সেই হিসাবে বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় পৌনে এক লাখ। তাদের এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ২৫ হাজার শিশু তাদের প্রথম জন্মদিনের আগেই মারা যায়। বিশ্বজুড়ে নবজাতকের মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ হৃদরোগজনিত, আর বাংলাদেশে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি শিশুদের প্রায় ৩০ শতাংশের হৃদরোগ শনাক্ত হয়। ত্রুটিযুক্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে প্রতি বছর জন্ম নেওয়া বিপুল নবজাতকের মধ্যে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার চিকিৎসার আওতায় আসে। বাকিরা থেকে যায় চিকিৎসার বাইরে। দেশের শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তারা বলেন, দেশের শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে জন্মগত হৃদরোগ। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে অন্তত ২০০ শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজারে। তার মধ্যে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার শিশু চিকিৎসার আওতায় এলেও ৯২ শতাংশ শিশু চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়। উন্নত বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশে হৃদরোগের ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুর হার প্রায় দেড়গুণ।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগের ত্রুটি নিয়ে জন্মানো ২৫ শতাংশ নবজাতকের পরিবারকে চিকিৎসার জন্য সম্পদ বেচতে হয়। জনসচেতনতার অভাব, বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতা এবং আর্থিক অক্ষমতার কারণে অনেক শিশু সঠিক সময়ে চিকিৎসা পায় না। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা অপরিহার্য।
প্রখ্যাত হৃদরোগ সার্জন অধ্যাপক ডা. এস আর খান বলেন, ২০০০ সাল থেকে বিশ্ব হার্ট দিবস প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। হৃদরোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়। এই প্রতিরোধ নীতির কার্যকারিতা একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে। যেমন, কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে শিশুদের বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাত্র ২০ পয়সার সিরিন ট্যাবলেট দিয়েই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব, অথচ একটি হার্ট ভালভ পরিবর্তন করতে খরচ পড়তে পারে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ কারণে প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর ও সস্তা উপায়।
তিনি বলেন, হৃদরোগের প্রতিকার সম্ভব, তবে এর জন্য আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা, নিয়মিত এক্সারসাইজ, ধূমপান বর্জন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমবে। মানসিক চাপ এড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ, যা নতুন বিয়ে, চাকরি বা পরিবেশ পরিবর্তনের মতো পরিস্থিতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে একটি প্রধান ঝুঁকি হলো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বিবাহ, যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাই-বোনের মধ্যে। এ ছাড়া চিকিৎসা না হওয়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি এবং ভাইরাল রোগও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তবে এসবের প্রতিকারও সম্ভব।
স্বাস্থ্যবীমার গুরুত্বও উল্লেখ করে ডা. খান বলেন, স্বাস্থ্যবীমা থাকা অত্যন্ত জরুরি, হোক তা প্রাইভেট সেক্টর বা সরকার সমর্থিত। যদি না থাকে, একজন রোগীকে নিজ পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়, যা বিপজ্জনক। পশ্চিমা দেশগুলোতে সরকার সহায়তা করে, সেখানে রোগীকে পকেট থেকে টাকা দিতে হয় না। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। আমরা আশা করি, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যাবে এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে এটি বড় অবদান রাখবে।
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা বলেন, বাংলাদেশে জন্মগত হৃদরোগের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন দুই শতাধিক শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে, বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৪ হাজারে। এটি ডেঙ্গু বা কভিডের মতো একটি মহামারি রোগ। তবু জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জন্মগত হৃদরোগ এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শিশুদের সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য অবকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি নবজাতককে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে জটিলতা দেখা দেওয়ার আগে চিকিৎসা দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, গত দুই দশকে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞরা এখন রোগীদের শনাক্ত করে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠাচ্ছেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত দুর্বলতা এখনো রয়ে গেছে। ২০১৩ সালের দিকে মাত্র ১২ থেকে ১৬ জন কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ এবং ছয় থেকে আটজন কার্ডিয়াক সার্জন কাজ করতেন। বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাড়ানো না হলে শিশু হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।
তিনি জাতীয় কর্মসূচির ঘাটতির কথাও তুলে ধরেন। জন্মগত হৃদরোগকে এখনো শিশু রোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও আইএমসিআই শিশুদের রোগ শনাক্ত ও ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, হৃদরোগকে বাদ দিয়ে দেওয়ায় অনেক শিশু সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছে না। আমাদের দেশকে অবশ্যই একটি সমন্বিত ও দৃঢ় পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা আরও কার্যকরভাবে করা যায়।
বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার প্রথমবারের মতো দেশের শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে শিশু হৃদরোগের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কিডস হার্ট ফাউন্ডেশন (কেএইচএফ), চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশ (সিএইচটিবি), বাংলাদেশ হার্ট রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচআরএ) এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যঅডাল্ট অ্যান্ড কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ। অনুষ্ঠানের শুরুতে ডা. এম এ কে আজাদ এবং ডা. আশিক মাহমুদ রায়হান চৌধুরী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা বাংলাদেশের শিশু হৃদরোগের বর্তমান অবস্থা, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে কি-নোট পেপার উপস্থাপন করেন।
এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সভাপতি রাশেদ রাব্বি। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অধ্যাপক ডা. তারিকুল ইসলাম, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ঢাকার অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডিরেক্টর অব মেডিকেল সার্ভিসেস অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ সাফি মজুমদার, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডা. রেজওয়ানা রিমা, বিশিষ্ট পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট ডা. আবদুস সালাম প্রমুখ।
মন্তব্য করুন