মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩, ০৯:৩২ পিএম
আপডেট : ০৬ জুন ২০২৩, ১০:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ব্যাংকে ব্যাংকে শঙ্কা কুঋণ

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ, যা লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এ খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে মন্দ মানে শ্রেণীকরণ করা ঋণ। গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৭ শতাংশ।

এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এসব ঋণের বেশির ভাগই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। কারণ, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যা তাদের নিট আয়ে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। শুধু তা-ই নয়, মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। মন্দ ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃতপশিল ও পুনর্গঠনে ছাড় দেওয়া এবং সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, নির্ধারিত সময় শেষ হলেই পুরোনো খেলাপি ঋণগুলো মন্দ মানে পরিণত হয়। এ সময়ের মধ্যে নতুন খেলাপি যুক্ত হচ্ছে। ফলে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের সবটাই এক পর্যায়ে আদায় করা যাচ্ছে না। ঋণগুলো দেওয়ার সময়ই যথাযথ নিয়ম মেনে দেওয়া হয়নি। যে খাত দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে, সেখানে না যাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি নজরদারি বাড়ানো উচিত।

তিনি বলেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ওই ব্যাংকের জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের দুই ধরনের ক্ষতি হয়। একটি হচ্ছে, ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা পরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

অন্যদিকে, এ মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এটা করতে গিয়ে সরাসরি চাপ পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার সময় যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় রাখলে এ ঋণের পরিমাণ এমন হারে বাড়ত না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণীকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে- এক. নিম্নমান; দুই. সন্দেহজনক এবং তিন. মন্দমান বা ক্ষতিজনক। এসব পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনকের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর আগে গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্চ শেষে মন্দমানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৭ শতাংশ। এর আগে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, মন্দমানের খেলাপি ঋণের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণই রয়েছে ৫৪ হাজার ৫৩৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বা ৯৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

এর আগে ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণ ছিল ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের, ১৪ হাজার ৭১৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। দ্বিতীয়তে অগ্রণী ব্যাংক, মন্দ ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এরপর সোনালী ব্যাংক, ১১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৩৯৬ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৬ হাজার ৭৬৫ কোটি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৯২১ কোটি টাকার মন্দ ঋণ রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযাযী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও বাড়ছে মন্দমানের খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৫৩ হাজার ১৮১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এসব ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকে, ৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইমলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, এর পরিমাণ ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এবি ব্যাংক, এর পরিমাণ ৩ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে আটটি ব্যাংক। অগ্রণী, বেসিক, রূপালী, বাংলাদেশ কমার্স, ঢাকা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।

এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, যা এর আগে গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৯ হাজার ৪৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের, ৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। এর পরই আছে বেসিক ব্যাংক, ঘাটতি ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণীর ৪ হাজার ১০ কোটি, রূপালীর ৩ হাজার ৮০ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৬০ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৫৯ কোটি ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। তবে এ সময়ে বেশ কিছু ব্যাংকের প্রভিশন উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে ঘাটতির পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

চাঁদপুরে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

অটোমেটেড মেশিনের দিকে ঝুঁকছে পোশাক কারখানার মালিকরা

ব্যারিস্টার সুমন গ্রেপ্তার

মধ্যরাতে ব্যারিস্টার সুমনের ভিডিও বার্তা

ব্যারিস্টার সুমন কি গ্রেপ্তার হয়েছেন?

আইটেক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ভারতে গেলেন ১০ কর্মকর্তা

চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেপ্তার ৩

শুরু হলো আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ৭১ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প

১০

বাবা হত্যার দায়ে ছেলের মৃত্যুদণ্ড

১১

দৌলতদিয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আটক

১২

বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে প্রাণ গেল কিশোরের

১৩

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বেরোবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৪

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিধি বাড়ানোর দাবি রাশেদ খাঁনের

১৫

শেখ হাসিনা পালায় না, ভেগে যায় : আমান উল্লাহ আমান

১৬

পুলিশে নিয়োগ হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে : পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল

১৭

ডেঙ্গুতে আরও ৩ মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়াল অর্ধলক্ষ

১৮

চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন 

১৯

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু

২০
X