

বাংলাদেশের এক অনন্য বৈচিত্র্যময় ও মনোরম প্রাকৃতিক ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম। সবুজে মোড়ানো উঁচু-নিচু পাহাড়, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নদী, হ্রদ, ঝর্ণা ও জলপ্রপাত— সব মিলিয়ে এ জনপদ যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত ক্যানভাস। ছয় ঋতুর আবর্তনে পাহাড়ি প্রকৃতি বারবার রূপ বদলায়।
কখনো কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের চূড়ায় থমকে থাকে নীল আকাশ, কখনো বর্ষার মেঘ নেমে আসে পাহাড় ছুঁয়ে। বর্ষায় নদী কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলে, ঝর্ণা প্রাণ ফিরে পায়, আর সবুজ পাহাড় জলে-আকাশে নিজের ছায়া আঁকে। এই প্রকৃতির বুকে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি মানুষের জীবন, আর সেই জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জুম চাষ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, বম, খুমি ও তঞ্চঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। অরণ্যের সবুজে মাচা বেঁধে গড়ে ওঠা তাদের ঘরবাড়ি, পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে থাকা বসতি আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক পাহাড়ি জীবনকে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
শত শত বছর ধরে এই জনগোষ্ঠীগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জুম চাষ করে আসছে। জুম চাষ তাদের কাছে শুধু খাদ্যের জোগান নয়, বরং এটি সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন ও জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ পাহাড়ি মানুষ কোনো না কোনোভাবে জুম চাষের সঙ্গে জড়িত।
জুম চাষকে ঘিরে পাহাড়ি জীবনে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি। কবিতা, গান, ছড়া ও প্রবাদ-প্রবচনে উঠে এসেছে জুম ও পাহাড়ি জীবনের কথা। চাকমা ভাষার একটি কবিতায় বলা হয়— “ও ভেই যেই বেক্কুনে মিলি জুম কাবা যেই, পূব ছড়া থুমত বর রিজেভ টুগুনোত। পুরান রাঙ্গা ভূঁইয়ানি এবার বলি উত্যে হোই চেগার, সে জুমোনি এ বঝরত মিলিমুলি খেই।” অর্থাৎ, ও আমার ভাই বন্ধুরা চল সবাই মিলে জুম কাটতে যাই, বড় বড় পাহাড়ের চূড়ায় দূরের পূর্ব ছড়ার শেষ সীমানায়। আগে জুম করা ভূমি আবার উর্বর হয়েছে, এ বছর মিলে-মিশে সেগুলো চাষ করে খাবো। এই কবিতার মধ্যেই ফুটে ওঠে পাহাড়ি মানুষের সম্মিলিত জীবনবোধ ও প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক।
বর্ষা শেষে পাহাড়ের ঢালে জুম চাষের প্রস্তুতি শুরু হয়। জঙ্গল পরিষ্কার করে গাছপালা কেটে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হয় জমি। এরপর ছোট দা বা লাঠির সাহায্যে মাটিতে ছোট ছোট গর্ত করে একসঙ্গে নানা ধরনের ফসলের বীজ বপন করা হয়। ধান, ভুট্টা, তিল, মিষ্টি কুমড়া, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন ফসল একই জমিতে পাশাপাশি বেড়ে ওঠে। পাহাড়ি নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর—সবাই মিলেই এই চাষাবাদে অংশ নেয়। জুম চাষ তাই কেবল কৃষিকাজ নয়, এটি এক ধরনের সামষ্টিক শ্রম ও সামাজিক বন্ধনের প্রতিফলন।
জুমের ফসল পরিচর্যার জন্য পাহাড়ের ঢালে জুমিয়ারা গড়ে তোলেন অস্থায়ী মাচাং ঘর, যা চাকমা ভাষায় ‘মোনঘর’ নামে পরিচিত। চাষাবাদের পুরো মৌসুমে তারা এই মোনঘরেই অবস্থান করেন। এখান থেকেই ফসলের দেখভাল করা হয় এবং বুনো শুকরসহ বিভিন্ন জীব-জন্তু ও পাখি যেন ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হয়। জুমের জমির চারপাশে ‘কাবুক’সহ নানা ধরনের ফাঁদ পাতা হয়, যেখানে তঞ্চঙ্গা জুমিয়াদের দক্ষতা বিশেষভাবে পরিচিত।
জুম চাষকে ঘিরে পাহাড়ি জীবনে আনন্দ, পরিশ্রম ও উৎসব একসূত্রে বাঁধা। ফসল ঘরে তোলার সময় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ ফিরে আসে। গান, নাচ আর সম্মিলিত ভোজের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার তুলনায় জুম চাষ নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও পাহাড়ি মানুষের কাছে এটি শুধুই কৃষিপদ্ধতি নয়; এটি তাদের পরিচয়, ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের অংশ। শতাব্দীর পরী ধরে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে গড়ে ওঠা এই জীবনব্যবস্থা পাহাড়ি সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল।
মন্তব্য করুন