

নতুন বছরের প্রথম প্রহরে ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটায় পৌঁছাতেই বদলে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা। শুভেচ্ছাবার্তা আর নতুন স্বপ্নে ভরে ওঠে চারপাশ। আমরা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই, আজ থেকেই শুরু হলো আরেকটি (ইংরেজি) নতুন বছর। কিন্তু এই ‘নতুন বছর’ আসলে কেন ঠিক ১ জানুয়ারিতেই শুরু হয়? পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের সঙ্গে কি এই তারিখের কোনো সরাসরি সম্পর্ক আছে, নাকি এটি ইতিহাসের ধারায় গড়ে ওঠা মানুষেরই একটি সিদ্ধান্ত?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরতে হবে হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসে, প্রাচীন রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ইউরোপ হয়ে আধুনিক বিশ্বের ক্যালেন্ডার ব্যবস্থার বিবর্তনের দিকে। জানুয়ারির ১ তারিখের এই যাত্রাপথ শুধু একটি তারিখ নির্ধারণের গল্প নয়, বরং সময়কে বোঝা ও সাজানোর মানুষের দীর্ঘ প্রচেষ্টার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
জানুয়ারির ১ : ক্যালেন্ডারের বিবর্তন ও রোমান ইতিহাস
নতুন বছরের সূচনার ধারণা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা মূলত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত।
১. আদি রোমান ক্যালেন্ডার ও মার্চের শুরু
প্রাচীন রোমে বছরের শুরু জানুয়ারিতে নয়, বরং ১ মার্চ থেকে হতো। সে সময়কার ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টি এবং মোট দিনের সংখ্যা ছিল ৩০৪। আজও এর ছাপ রয়ে গেছে আমাদের পরিচিত মাসগুলোর নামের মধ্যে। যেমন—ল্যাটিন শব্দ Septem মানে সাত, তাই সেপ্টেম্বর ছিল সপ্তম মাস; Decem মানে দশ, তাই ডিসেম্বর ছিল দশম মাস।
তবে এই ক্যালেন্ডারে বড় সমস্যা ছিল, ঋতুর সঙ্গে দিনের হিসাব মিলত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকাজ, উৎসব ও প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্য প্রকট হয়ে ওঠে।
২. জানুসের নামানুসারে জানুয়ারি ও জুলিয়াস সিজার
এই সমস্যার সমাধানে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে ক্যালেন্ডারে বড় ধরনের সংস্কার আনেন। এই সংস্কার থেকেই জন্ম নেয় ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’। সিজারই প্রথম জানুয়ারির ১ তারিখকে বছরের সূচনা হিসেবে ঘোষণা করেন।
জানুয়ারি মাসের নামকরণ করা হয় রোমান দেবতা ‘জানুস’-এর নামানুসারে। জানুসের দুটি মুখ—একটি অতীতের দিকে, অন্যটি ভবিষ্যতের দিকে তাকানো। অতীত ও ভবিষ্যতের সংযোগস্থল হিসেবে জানুসকে নতুন শুরুর প্রতীক ধরা হতো। এই প্রতীকী অর্থেই জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
৩. মধ্যযুগ ও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রভাব
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপের অনেক খ্রিস্টান দেশ জানুয়ারির ১ তারিখকে বছরের শুরু হিসেবে মানতে চায়নি। কোথাও ২৫ মার্চ (অ্যানানসিয়েশন ডে), কোথাও আবার ২৫ ডিসেম্বর (ক্রিসমাস) থেকে বছর গণনা করা হতো।
এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটে ১৫৮২ সালে, যখন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের ত্রুটি সংশোধন করে ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ প্রবর্তন করেন। এতে আবারও ১ জানুয়ারিকে বছরের আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে নেয়, যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১ জানুয়ারি পালনের তাৎপর্য
বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে— বাংলায় পহেলা বৈশাখ, চীনা নববর্ষ কিংবা ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জি। তবু জানুয়ারির ১ তারিখ একটি বৈশ্বিক মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই দিনটি একটি অভিন্ন সূচনা বিন্দু হিসেবে কাজ করে।
সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস
মন্তব্য করুন