শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
রেজওয়ান রনি, রংপুর
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৪০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আমাদের ডাকবাক্সটি ছিল আপনজনের চেয়েও আপন

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের একটি চিত্র। ছবি : কালবেলা
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসের একটি চিত্র। ছবি : কালবেলা

‘বড় ভাইয়েরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত, কেউ চাকরির সুবাদে বাইরে থাকত। তখন তাদের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করতাম। প্রত্যন্ত গ্রামের সেই ‘লাল ডাকবাক্সের’ দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম কবে চিঠি আসবে। সবসময় একটা হলুদ খামের অপেক্ষায় থাকতাম। অপেক্ষা শুধুই একটি ‘হলুদ খামের’। ডাকপিয়নের আলাদা একটা পোশাক ছিল। চিঠি এলে বাড়ির সামনে সাইকেল নিয়ে টুংটাং শব্দ করত ডাকপিয়নরা। চিঠি, চিঠি আছে! তারপর ভোঁ দৌড়। তার হাত থেকে চিঠি পেয়ে সে কি আনন্দ!’

চিঠি চালাচালির সেই সোনালি দিনের স্মৃতিচারণ করে করে এসব কথা বলছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান।

তিনি বলেন, দুটি প্রজন্মকেই দেখার সুযোগ হয়েছে। চিঠি পাঠানোর ওই যুগটাতে মানুষ চিঠি পাঠিয়েই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। প্রেম, প্রণয় কিংবা বিরহের বার্তা বহন করত একটা হলুদ খাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে মাসের প্রথম দিকে তীর্থের কাকের মতো ডাকবাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বারবার খোঁজ নিতাম মানি অর্ডার এলো কি না। হলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকবাক্সটি ছিল আপনজনের চেয়েও আপন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি মজার ঘটনা স্মৃতিচারণ করেন তিনি। নামের সঙ্গে মিল থাকায় অন্য একজনের প্রেমের চিঠি গ্রহণ করেন। চিঠি খুলে পড়ে বুঝতে পারেন এটি তার কাছে আসেনি। পরে খামের মুখ মুড়িয়ে যার চিঠি তাকে দিয়ে আসেন।

তিনি বলেন, এখন আর মানুষ চিঠি লেখে বলে আমার মনে হয় না। হাতে লেখা চিঠির যুগ আর ফিরে আসবে না। আমরা চিঠি পাঠানোর ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি। ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে’ প্রেমিকার কাছে কবি মহাদেব সাহার এমন আকুতি ১৫-২০ বছর আগে হলেও স্বাভাবিক ছিল। তখন বহুপথ পাড়ি দিয়ে লাল ডাকবাক্সে চিঠি জমা দিয়ে ফিরতে হতো বাড়ি। তার পরই শুরু হতো চিঠির প্রতিউত্তরের আশায় অপেক্ষার প্রহর গোনার দিন। কিন্তু সেদিন গোনার আবেগ-আকুতি এখন বদলেছে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আর ইমেইলে।

ডাকবাক্সের গায়ের লাল রং এখন ক্রমেই হালকা হয়েছে। ডাকঘর আর ডাকবাক্স কী কাজে আসে—এ প্রজন্মের অনেকের কাছে তা এখন অজানা। শেষ কবে চিঠি লিখেছেন বা পেয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকেই দিতে পারবে না। প্রযুক্তির কল্যাণেই চিঠি লেখার শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

নতুন প্রজন্মকে চিঠিপত্র, ডাকবাক্সের সঙ্গে পরিচয় করাতে কিছুদিন আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চিঠি উৎসব’ আয়োজন করেছিলেন একদল শিক্ষার্থী। আয়োজকদের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা উষা বলেন, চিঠি উৎসবে সবার সাড়া পেয়ে আমরা মুগ্ধ। শত শত শিক্ষার্থী হাতে চিঠি লিখেছে। কেউ তার মাকে, কেউ ভাইকে, কেউ আবার প্রেমিকার জন্য ভালোবাসার শব্দমালা জুড়ে দিয়েছেন চিঠিতে।

ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলাজুড়ে মোট ৬৮টি ডাকঘর আছে। এর মধ্যে মহানগর এলাকায় ১৮টি। ডাক বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের ফলে বেশকিছু নতুন সেবা যুক্ত হয়েছে। টাকা পাঠাতে কম খরচে ‘ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার’ কম সময়ে পার্সেল পাঠাতে ‘স্পিডপোস্ট’ সেবা পাচ্ছেন গ্রাহকরা। এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাদের গ্রাহকের হাতে পণ্য পাঠাচ্ছে সহজে ও খুব কম খরচে। তবে বর্তমানে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠানো কমে গেলেও সরকারি কাগজপত্র পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ডাক বিভাগ। দাপ্তরিক কাজের নথি বা আবেদনপত্রের কাজ ছাড়া মানুষ খুব একটা ডাকঘরে আসে না।

নীলফামারীর সৈয়দপুরের গোলাহাট ওয়াপদা ডাকঘরে ২০ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন ডাকপিয়ন মো. আজিজার রহমান। তিনি বলেন, ২০০৪ সালে যখন ডাকপিয়ন হিসেবে যোগদান করেন, তখন মানুষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পুরোপুরি চিঠির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০১০ সালের পর থেকে চিঠি পাঠানোর সেই যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন এখানে দাপ্তরিক চিঠি, মামলা-মোকদ্দমার উকিল নোটিশ, জমিসংক্রান্ত কাগজ, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চিঠি আসে।

তিনি বলেন, আমরা ভাতাভুক্ত কর্মচারী, বেতন-ভাতা খুব সীমিত। সারা মাস কাজ করে ৪ হাজার ৩৫০ টাকা ভাতা পাই। তার প্রশ্ন—এই টাকায় এ যুগে কী হয়। বেতন-ভাতা বাড়ানো, চাকরি জাতীয়করণ করলে তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরবে বলে জানান তিনি।

চিঠি বিলির একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, একবার এক দরিদ্র পরিবারের জমানো ১ লাখ টাকার ডকুমেন্টস তাদের হাতে তুলে দিই। এ সময় তারা কান্নাকাটি শুরু করে। আমিও আর নিজেকে সামাল দিতে পারিনি। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে মানুষের চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দিতে গিয়ে আনন্দ মুহূর্তের সাক্ষি হয়েছি। মানুষের ভালোবাসা পাই, এটাই বড় বিষয়। এজন্য এত কম বেতন-ভাতাতেও এতদিন ধরে চাকরি করছি।

কুরিয়ার সার্ভিস ২৪ লিমিটেডের রংপুর জোনাল ইনচার্জ এনামুল ইসলাম বলেন, প্রতিযোগিতার এ বাজারে দ্রুততার সঙ্গে পার্সেল আদান-প্রদান করতে পারলে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে ডাক বিভাগ। পুরো প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও বিনিয়োগে বড় পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলে মানুষ আবারও ডাক বিভাগমুখী হবে।

রংপুরের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল ইসরাত জাহান নুর কালবেলাকে বলেন, ডাক বিভাগে নতুন নতুন কিছু সেবা যুক্ত হয়েছে। আমরা একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবাগুলো পৌঁছে দিচ্ছি। সেবাগুলোর ব্যাপারে মানুষকে জানাতে প্রচার-প্রচারণা করা হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

 ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘তুই’ বলায় তুমুল সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বর্জন

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : গণতন্ত্র মঞ্চ 

চার দেশে বন্যায় ১৫০০ মৃত্যুর পর নতুন আতঙ্ক

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ স্থগিত

শাহজালালে ‘এয়ারপোর্ট মিনি ফায়ার এক্সারসাইজ-২০২৫’ সম্পন্ন

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম

ইউএনও হলেন লাক্স সুন্দরী সোহানিয়া

তারেক রহমানের ৩১ দফায় বদলে যাবে শরীয়তপুর : নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপু

এরশাদ-হাসিনা কারও সঙ্গেই আপস করেননি খালেদা জিয়া : মিল্লাত

মান্নাকে ইসলামী ব্যাংকের চূড়ান্ত নোটিশ, আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি

১০

সব দল ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হবে ইনশাআল্লাহ : অধ্যাপক মুজিবুর

১১

মনোনয়নের খবর শুনে উচ্ছ্বাস, কিছুক্ষণ পর বিএনপি নেতার মৃত্যু

১২

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যা / সাবেক বিচারপতি-হুইপসহ ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট

১৩

ইসলামের বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

১৪

ববি উপাচার্য দপ্তরে ‘মুলা’ ঝুলিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ

১৫

ধেয়ে আসছে তীব্র শীত, দফায় দফায় শৈত্যপ্রবাহ

১৬

‘বাকসু’ নিজেদের রাখতে বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের হুঁশিয়ারি

১৭

নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে ২ রাজনৈতিক দল

১৮

বেওয়ারিশ কুকুরের প্রতি সামিনের ‘অদ্ভুত’ ভালোবাসা

১৯

ডিসেম্বরেই তিনশ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে এনসিপি : সারজিস

২০
X