খুলনা বিএমএর সভাপতি ডা. বাহারুল আলম বলেন, সাদা পোশাকে একজনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অথচ পুলিশ ও আদালত জানবে না তারা কোথায় আছে, এটা হতে পারে না।
তিনি বলেন, তাদের অপরাধ থাকলে বিচার হোক, কিন্তু পরিবার জানুক তাদের অপরাধ। এটা পুলিশি রাষ্ট্র নয়, এটা সিভিল রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একজন পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থান জানাতে পারবে না এটা পুলিশের ব্যর্থতা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কাম্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সোমবার (২১ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে বিএমএ খুলনার কার্যালয়ে খুলনা থেকে সিআইডি পরিচয়ে উঠিয়ে নেওয়া চার চিকিৎসকের অবস্থান জানতে চেয়ে আয়োজিত স্বজনদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন খুলনা বিএমএ সভাপতি।
এ সময় চার চিকিৎসকের স্বজনরা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের উৎকন্ঠার কথা জানায়। স্বজনরা বলেন, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি তারা। তাদের সন্তানদের অপরাধ ও নিখোঁজের বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করছেন তারা। একইসঙ্গে চিকিৎসকদের কোনো অপরাধ থাকলে তাদের আদালতে সোপর্দ করার আবেদন করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা পরিচয়ে উঠিয়ে নেওয়া চিকিৎসকদের বাবা-মা ও স্বজনরা। এ সময় মুসতাহিন হাসান লামিয়ার মা ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ১৮ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে ৪ থেকে ৫ জন লোক আসেন আমাদের বাসায়। আমার মেয়ে লামিয়া বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাতের ডিউটি শেষ করে এসে সবেমাত্র বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারা নিজেদের সিআইডি পরিচয় দিয়ে সমস্ত ঘর তল্লাশি শুরু করে। ঘরের বিছানা ও আসবাবপত্র তছনছ করে দেয়। আমার মেয়ের দুটি ছোট ছোট বাচ্চা রয়েছে। এতো লোকের উপস্থিতি ও চিৎকার চেঁচামেচিতে তারা কান্না জুড়ে দেয়। পরে তারা আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়। আমরা এর কারণ জানতে চাইলে তারা রুঢ় কথা বলতে থাকে। এভাবে নিয়ে যেতে আদালতের ওয়ারেন্ট আছে কিনা জানতে চাইলে তারা কোনো জবাব দেয়নি। কথা বলার এক পর্যায়ে সিআইডি পরিচয় দেয়া ব্যক্তিরা প্রস্তাব দেন যে, মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে ডা. তারিমের সম্পর্ক রয়েছে এই কথা বললে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেসময় আমরা অপরাগতা প্রকাশ করলে আমার মেয়েকে তারা ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। কোথায় আছে কিভাবে আছে বেঁচে আছে কিনা কিছুই জানি না। বাধ্য হয়ে আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়ের খোঁজ নিতে চাই।
ডা. লুইস সৌরভের মা ম্যাটলেট সরকার বলেন, ১৮ তারিখ ভোর তিনটার দিকে তাদের বাসায় একদল লোক আসে। নিচ থেকে জোরে জোরে গেট খুলে দিতে বলে। আমি অসুস্থ মানুষ, নিচে নেমে কারা পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের সিআইডি পরিচয় দেয়। এসময় তারা আমার ছেলে লুইস সরকারের খোঁজ নিতে চায়। আমি বলি সে বাড়িতে নেই। এরপরও তারা জোরে জোরে গেট ধাক্কাতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের সার্চ ওয়ারেন্ট বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কিনা জানতে চাইলে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ভয়ভীতি দেখায়। পরে বাধ্য হয়ে গেট খুলে দেই। পরে তারা লুইসের কক্ষে গিয়ে তছনছ করে ফেলে। ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে শুরু করে মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে নেয়। লুইস তার পাশের মামার বাড়িতে রয়েছে জানতে পেরে তারা সেখানে গিয়ে লুইসকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে যায়। সেই নম্বরে আমরা গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৫০০ বার ফোন দিলেও ফোনটি কেউ রিসিভ করেনি। আমাদের ছেলে কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, কিভাবে রাখা হয়েছে আমরা কিছুই জানি না। অন্ততঃপক্ষে আমার ছেলের অবস্থান জানতে চাওয়াটা আমার নাগরিক অধিকার।
মেয়েদের উঠিয়ে নিযে যাওয়ার বিষয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন ডা. শর্মিষ্ঠা মণ্ডলের বাবা ডা. দীনবন্ধু মণ্ডল ও ডা. নাজিয়া মাহজাবিন তিশার মা নিলুফার ইয়াসমিন। তারা তাদের সন্তানদের বর্তমান অবস্থান এবং কোন অপরাধে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটি জানতে চায়। যারা নিয়ে গেছে তারা আদৌ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক কিনা সেটি নিয়েও তারা সন্দিহান।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ আগস্ট সকালে খুলনায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি কোচিং থ্রি ডক্টরসের উপদেষ্টা ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে আটক করে সিআইডি। খুলনা সদর থানা পুলিশের ওসি হাসান আল মামুন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। পরদিন জানা যায়, ১৮ আগস্ট রাতে দুই চিকিৎসক এবং ১৯ আগস্ট সকাল থেকে আরও দুই জন চিকিৎসক নিখোঁজ হয়েছেন। তাদেরও সিআইডি আটক করেছে বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ করা হচ্ছে। তবে সিআইডির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। গত দুই দিন সিআইডি সদর দপ্তরে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও এই বিষয়ে কেউই মুখ খোলেনি। মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সেটি রিসিভ করা হয়নি। নিখোঁজ অন্য চিকিৎসকরা হলেন, ডা. লুইস সৌরভ সরকার, ডা. নাজিয়া মাহজাবিন তিশা, ডা. মুসতাহিন হাসান লামিয়া ও ডা. শর্মিষ্ঠা মণ্ডল।
চিকিৎসকদের উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়ে খুলনা বিএমএর সভাপতি ডা. বাহারুল আলম বলেন, নিখোঁজ চিকিৎসকদের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা কয়েকবার সোনাডাঙ্গা ও সদর থানায় সরাসরি ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেছি। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে আমাদের জানিয়েছেন। তাদের সন্ধান চেয়ে আমরা কেএমপি কমিশনারকেও লিখিতভাবে জানিয়েছি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মন্তব্য করুন