আতিকুর রহমান, কুমিল্লা
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পাঁচ বছরে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে অন্তত ৩৫ প্রাণহানি

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের কালিকাপুর এলাকার অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। ছবি : কালবেলা
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের কালিকাপুর এলাকার অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। ছবি : কালবেলা

দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের আওতায় ১৮৪ কিলোমিটার রেলপথ। গত পাঁচ বছরে শুধু অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ২১টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

জেলার মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়াখালী ও লাকসাম-চাঁদপুর তিনটি রেলপথ গিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়াখালী ও লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লাকসাম রেলওয়ে থানা পুলিশ। কুমিল্লার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রয়েছে ৬১টি লেভেল ক্রসিং। এর মধ্যে অরক্ষিত ৩২টি। এই লেভেল ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক যেমন নেই, নেই গেটম্যানও।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে দাবি জানিয়ে এলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা পূরণ হয়নি। এজন্য অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে চলাচলের সময় দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বল্প জনবল নিয়ে ১৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে নজরদারি করা কঠিন। অবৈধ লেভেল ক্রসিং দিয়ে চলাচলের ব্যাপারে এলাকাবাসীকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে রেলগেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।

সর্বশেষ গত বুধবার (২৩ এপ্রিল) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের মাধবপুর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে তিন যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বুড়িচংয়ের দুর্ঘটনার আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে গত পাঁচ বছরে মোট ১৬টি দুর্ঘটনা ঘটে।

চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি রাত পৌনে ৮টার দিকে কুমিল্লা শাসনগাছা রেলগেট এলাকায় আবু মুছা নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি সকাল ৯টায় কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড লেভেল ক্রসিং এলাকায় সুবর্ণ এক্সপ্রেসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওয়াজিহ উল্লাহ ভূঁইয়া রনি নামে এক ব্যবসায়ী মারা যান। ১৩ জানুয়ারি সকাল ৯টার দিকে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মক্রবপুর ইউনিয়নের বান্নাঘর শাহ রৌশন দরগাবাড়ি মাজার এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় ফাতেমা আক্তার নামে এক নারীর মৃত্যু ঘটে।

সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের বুড়িচংয়ের কালিকাপুর লেভেল ক্রসিং এলাকায়। এ দুর্ঘটনায় ট্রেনের ধাক্কায় এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকসহ সাতজন ঘটনাস্থলে নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুল গ্রামের আলী আহমদ, রফিক মিয়া, সাজু মিয়া, লুৎফা বেগম, সানু বেগম ও সফরজান বেগম এবং পাশের খোদাইধুলী গ্রামের হোসনে আরা বেগম।

২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর লালমাই উপজেলার হরিশ্চর এলাকায় এক নারী, ২৪ জুন সদর দক্ষিণ উপজেলার শিকারপুর এলাকায় এক ব্যক্তি, ৮ জুন নাঙ্গলকোট সদরের বিশারা এলাকায় এক বৃদ্ধ, ১৬ মে আদর্শ সদর উপজেলার রসুলপুরে এক ছাত্রী, ২৫ জানুয়ারি নাঙ্গলকোট পৌর বাজারের পাশে এক এনজিও কর্মকর্তা রেল দুর্ঘটনায় মারা যান।

২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদল সেনের বাজার এলাকায় এক অটোরিকশাচালক, ৩ জুন সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর সংলগ্ন জেলখানা বাড়িতে অটোরিকশা চালক বাবা ও ছেলে এবং একই বছরের ১৯ মে লাকসাম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এক স্কুলশিক্ষক নিহত হন। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লাকসাম পৌরসভার এতিমখানা সড়কে অবৈধ ক্রসিংয়ে এক যুবক এবং একই বছরের ২৯ জানুয়ারি নাঙ্গলকোটের বান্নঘর এলাকায় এক ফল ব্যবসায়ী মারা যান।

এর আগে ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি বান্নঘর এলাকায় বাবা-ছেলে, ১০ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে এক বৃদ্ধা, ২৫ জানুয়ারি নাঙ্গলকোট পৌরবাজারের পাশে এক এনজিও কর্মকর্তা এবং ২৯ আগস্ট লালমাইয়ের হরিশ্চর এলাকায় অরক্ষিত ক্রসিংয়ে মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত হন।

অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের বাইরে বৈধ ক্রসিং ও রেলপথে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর লেভেল ক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় এক নারী ও এক শিশু নিহত হয়েছে। ২০২২ সালের ৯ মার্চ একই লেভেল ক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিশুশিক্ষার্থী নিহত হয়। ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর আদর্শ সদরের শাসনগাছা লেভেল সিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে আপন রবি দাসনামের এক যুবক নিহত হন।

স্থানীয়রা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের বিভিন্ন অবৈধ ক্রসিং বৈধ করার দাবি জানিয়ে আসছে। রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবিতে বিভিন্ন এলাকায় একাধিকবার মানববন্ধনও হয়েছে। কিন্তু আজও দাবি পূরণ হয়নি। অরক্ষিত বিভিন্ন ক্রসিং মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সেসব স্থানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ চলাচল করছে।

লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি এমরান হোসেন কালবেলাকে বলেন, লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন এলাকা হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ফেনীর ফাজিলপুর, লাকসাম-নোয়াখালী রুট এবংলাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে লাকসামের চিতোষীর আগ পর্যন্ত। এর মধ্যে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা লালমাই, সদর দক্ষিণ, বুড়িচং, নাঙ্গলকোটসহ কুমিল্লা জেলা এলাকা। অসচেতনতার কারণেই অনেকে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়ক পথের অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণহানি ঘটে।

জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) ছাদেকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, কুমিল্লায় রেলপথে থাকা অরক্ষিত ক্রসিংগুলোর ব্যাপারে আমরা অবগত। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেলগেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। কয়েকটি স্থানে রেলগেট নির্মাণসহ লোকবল নিয়োগ করা প্রয়োজন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘পিপিপি ডিভিশনাল কনফারেন্স চট্টগ্রাম ২০২৫’ অনুষ্ঠিত

৫ বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার 

চিন্ময় দাসের জামিন 

জেলে থেকেও অস্ত্র মামলায় আসামি স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা

অভিনেতা সিদ্দিক ৭ দিনের রিমান্ডে

প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ৭০ ঘর পেলেন কুমিল্লার বন্যা দুর্গতরা

সাকিবকে টপকে টেস্টে অনন্য কীর্তি মিরাজের

আদালত অবমাননার অভিযোগে হাসিনাসহ দুজনকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ

ভারতে চিকিৎসা না পেয়ে দেশে ফেরা শিশুদের পাশে পাকিস্তান সরকার

কর্ণফুলী নদী থেকে ক্ষুদে ক্রিকেটারের মরদেহ উদ্ধার

১০

গাজীপুরে দুই কারখানা বন্ধ ঘোষণা

১১

মিনিস্টার ফ্রিজ কিনুন হাম্বা জিতুন সিজন-০২

১২

পাকিস্তানের ধাওয়া খেয়ে পালাল ভারতের যুদ্ধবিমান

১৩

বাজারে কবে আসবে সাতক্ষীরার আম

১৪

ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারত ছাড়ছেন শত শত পাকিস্তানি

১৫

সাদমানের পর মিরাজের শতকে বাংলাদেশের ২১৭ রানের লিড

১৬

আদালতে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালানো সেই ইকবাল গ্রেপ্তার

১৭

কর্মবিরতি ও উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগে দুই কারখানা বন্ধ

১৮

হঠাৎ আকাশে উঠল পদ্মার পানি, ভিডিও ভাইরাল

১৯

বিএসইসির ২২ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত  

২০
X