ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও ভাঙচুর-লুটপাট হয় বিভিন্ন থানায়। এদিন জেলা পুলিশ ও নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। পুলিশের লুট হওয়া ১৫৩টি অস্ত্রের মধ্যে ৪২টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৯ হাজার ২৫টি গোলাবারুদের মধ্যে ৭ হাজার ৫১৮টি উদ্ধার হয়নি।
একইভাবে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের ৮৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসহ ১০ হাজার ৫৯৪টি গুলি লুট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ জেলায় মব জাস্টিস, সহিংসতা, হামলা ও সংঘর্ষের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। ফলে জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, দ্রুত লুট হওয়া অস্ত্রসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর গণঅভ্যুত্থানের সময় (৫ আগস্ট) থেকে বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি ও থানা থেকে ১৫৩টি অস্ত্র লুট হয়েছে। যার মধ্যে ৪২টি উদ্ধার হয়নি। চায়না রাইফেল লুট হয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়নি ৭টি। এসএমজি লুট হয়েছে ৪টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়নি একটি। একটি এলএমজি লুট হলেও সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পিস্তল লুট হয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়নি ১২টি। ১২ বোর শটগান লুট হয়েছে ৫৩টি; উদ্ধার হয়নি ১৬টি। গ্যাসগান লুট হয়েছে ১০টি; উদ্ধার হয়নি ৫টি।
এছাড়া ৯ হাজার ২৫টি গোলাবারুদ লুট হয়েছে। যার মধ্যে ৭ হাজার ৫১৮টি উদ্ধার হয়নি। ৩৯ মিমি সাইজের ৭.৬২ পিস্তলের গুলি ৩ হাজার ৩৮৭টি লুট হয়েছে। যার মধ্যে ২ হাজার ৮৭৭টি উদ্ধার হয়নি। ২৫ মিমি সাইজের ৭.৬২ পিস্তলের গুলি ৪৮৪টি লুট হয়েছে। যার মধ্যে ৩২৬টি এখনো উদ্ধার হয়নি। ১৯ মিমি সাইজের পয়েন্ট ৯ পিস্তলের গুলি ৪৪০টি লুট হয়েছে। যার মধ্যে উদ্ধার হয়নি ২৯১টি। শটগান কার্তুজ রাবার বল ১ হাজার ৩৪০টি লুট হয়েছে। এখনো ১ হাজার ১৬৮টি উদ্ধার হয়নি। শটগান কার্তুজ লিডবল ৩ হাজার ৪৫টি লুট হয়েছে; ২ হাজার ৭৩৩টি উদ্ধার হয়নি। লং রেঞ্জের টিয়ার গ্যাসের শেল ২০১টি লুট হয়েছে; ৪০টি উদ্ধার হয়নি। শর্ট রেঞ্জের টিয়ার গ্যাসের শেল ৮৭টি লুট হয়েছে। যার মধ্যে ৮৩টি উদ্ধার হয়নি। তবে লুট হওয়া ৪১টি সাউন্ড গ্রেনেডের সবই উদ্ধার হয়েছে।
একইভাবে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের ৮৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসহ ১০ হাজার ৫৯৪টি গুলি লুট হয়েছে। মামলা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ ও ৫ আগস্ট শহরের চাষাঢ়ায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে হামলা, ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। এ সময় ক্লাবের ভল্ট ভেঙে ভেতরে থাকা ৮৩টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১০ হাজার ৫৯৪টি গুলি লুটে নেয় হামলাকারীরা। পরে ক্লাবটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার প্রায় এক মাস পর অজ্ঞাতপরিচয় ২ হাজার ৫০০ জনকে আসামি করে গত ৭ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন ক্লাবের শুটিং সম্পাদক কাজী ইমরুল কায়েস। তবে মামলাটির তদন্তে কোনো গতি দেখা যায়নি।
রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে অটোমেটিক ও আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে ক্লাবের শুটিং সম্পাদক ও মামলার বাদী কাজী ইমরুল কায়েস কালবেলাকে বলেন, লুট হওয়া শুটিং অস্ত্রের মধ্যে ম্যানুয়াল ও অটোমেটিক অস্ত্র রয়েছে। অটোমেটিক অস্ত্র অপরাধীদের হাতে পড়লে তা অবশ্যই বিপজ্জনক। নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত ৬টি আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। এসব অস্ত্র দিয়ে অপরাধীরা নানা অপকর্ম করতে পারবে।
লুট হওয়া অস্ত্র ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল কালবেলাকে বলেন, ‘লুট হওয়া এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল, কিন্তু তেমনটি আমরা দেখিনি। এসব অস্ত্র ভুল লোকের হাতে চলে গেলে ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংঘর্ষ ও সহিংসতায় অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের মতো ঘটনা আমরা মনিটরিং করেছি। ফলে অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে না।’
পুলিশের অস্ত্র লুট হওয়ার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী কালবেলাকে বলেন, ‘লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। চেকপোস্ট বসিয়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তা ছাড়া পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধী ব্যবহার করেনি। ভবিষ্যতে অপরাধীরা যেন লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য পুলিশ সচেতন রয়েছে। সে সঙ্গে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে।’
রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) মো. হাসিনুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘রাইফেল ক্লাবের কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন। ভালো কোনো তদন্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। যাতে করে উদ্ধার কার্যক্রম আরও বেগবান হয়।’
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা কালবেলাকে বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রেখে তারা অস্ত্র উদ্ধারে কাজ করছে।’
মন্তব্য করুন