ছোট পাখি ফুলটুনি। গায়ের রঙে রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। ওড়ার ঢঙও দেখার মতো। ঠোঁটে লেগে থাকে গান। চঞ্চল ফুলটুনি সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায় এ-গাছ থেকে ও-গাছে। বাসা তৈরির ক্ষেত্রেও এদের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য।
ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানো প্রতিবেশী এই পাখিটি মধু চুষকি বা মৌটুসি নামেও পরিচিত। বাড়ির আঙিনায় শিম লতায়, সবজিক্ষেতে কিংবা আশপাশের ঝোঁপঝাড়ে এদের চঞ্চল বিচরণ। তবে ফুল-ফসলে ছিটানো বিষে দিনে দিনে কমছে প্রকৃতির অনিন্দ্য সৌন্দর্যের এই পাখি।
ফুলটুনি বা মৌটুসির ইংরেজি নাম পার্পল-থ্রোটেড সানবার্ড। বৈজ্ঞানিক নাম- লেপ্টোকোমা স্প্রেটা। ১ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার কাস্তের মতো নিম্নমুখী বাঁকানো ঠোঁট। লম্বায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার। ওজনে মাত্র ৭ থেকে ৯ গ্রাম। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে আলাদা। রোদের আলোয় পুরুষ পাখিটির গলার গাঢ় বেগুনি ব্যান্ড, পাখার গোড়ার অংশ ও মাথার চাঁদি থেকে চোখ ধাঁধানো চিকচিকে দ্যুতি ছড়ায়।
ব্যান্ডের নিচে বুক কমলা-হলুদ। বুকের কমলা, হলুদ রং পেছনের দিকে সাদায় মিলেছে। পায়ুপথের পালক সাদা। কালো পা। স্ত্রী পাখির ঘাড় মাথা ও পিঠ জলপাই রঙের। ধূসর গলা ও হলুদ বুক। পেট সাদাটে। ফুলের মধ্যে লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে মধু খাওয়ার সময় পাখা কাঁপিয়ে শূন্যে স্থির হয়ে থাকতে পারে। নান্দনিক সেই দৃশ্য বেশ উপভোগ্য।
ফুলটুনি, দুর্গাটুনি, বেগুনি-গলা মৌটুসি, সিঁদুরে-লাল মৌটুসি, মাকড়সাভূক মৌটুসি, নীল টুনি, সোনা চোখা, সিঁদুরে-হলুদ টুনি, সরষে টুনি, চুনিমুখোসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৌটুসি পাখির মধ্যে দেখতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চঞ্চল বেগুনি-গলার ফুলটুনি। এদের ঠোঁটে গান যেন লেগেই থাকে। খাবারের সন্ধানে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়, ডানা ঝাপটায় আর নাচেগানে মেতে থাকে আনন্দে। কলার মোচা, শিম, নারিকেল, রঙ্গনসহ বিভিন্ন ফুলের মধু আর তাল খেজুরের রস খেতেই এরা বেশি পছন্দ করে। ফুলের মধু প্রধান খাদ্য। খাবার সংকটে ছোট কীটপতঙ্গ খায়।
ঋতু বদলে তখনো ফুরফুরে ফাল্গুনি হাওয়া। প্রকৃতিতে বাসন্তী রং শেষ হয়নি। ফুলটুনির বাসা বাঁধার দিন। ঠিক এ সময় পাখিটিকে খুব কাছে থেকে দেখা ও এদের জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ ঘটে। একদিন বাসার ছাদে কাজ করার সময় দেখা মেলে সুরেলা ফুলটুনির।
সচরাচর এরা গাছের শাখায় ঠেকিয়ে ঝুলন্ত ডিম্বাকৃতির বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি বাসা বানায় ও ডিমে তা দেয়; ডিম সংখ্যায় দুটি ও সচরাচর ফোঁটা দাগযুক্ত। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ১৪ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে।
বাউফল উপজেলার কালিশুরী ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা বেগম বলেন, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড়শ প্রজাতির মৌটুসি বা ফুলটুনি পাখির কথা জানা গেছে। আমাদের দেশে আবাসিক পাখি ফুলটুনির ৯টি প্রজাতির সন্ধান মেলে। বাড়ির আশপাশে ঝুলন্ত ডালে এমনকি কাঠের তৈরি দোতলা ঘরের বারান্দায়, কার্নিশেও বাসা বানাতে দেখা যায়। তিনি জানান, সাধারণত মার্চ থেকে জুন এদের প্রজনন সময়। কখনো কখনো তা জুলাই-আগস্টেও গড়ায়। বাসা বানায় থলের মতো। বাসার ওপরের দিকে থাকে ঢোকার পথ। ভারসাম্য রক্ষায় মাকড়সার জালে ঝুলানো থাকে লতাপাতা। ফুলটুনি অত্যন্ত চঞ্চল ও চতুর।
তাসলিমা বেগম বলেন, আবহাওয়ার বৈরী প্রভাব, গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়া এবং ফুল-ফসলে কীটনাশক ছিটানোয় ফুলটুনির মতো ছোট পাখিগুলো কমছে।
মন্তব্য করুন