রংপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৫, ০৫:৩৯ পিএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে পুড়ল ধান, কৃষকের আহাজারি

রংপুরের পীরগাছায় ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে পুড়ল ধান। ছবি : কালবেলা
রংপুরের পীরগাছায় ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে পুড়ল ধান। ছবি : কালবেলা

জীবনের পড়ন্ত বেলায় বেঁচে থাকার তাগিদে ঋণের টাকা শেষ সম্বল ৩৬ শতক জমিতে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন রংপুরের কৃষক বামন সর্দার গ্রামের দীননাথ চন্দ্র বর্মণ। পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের সেই কৃষকের ধানক্ষেত পুড়ে গেছে ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে।

এমনকি নিজের খাবার, ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় তিনি। ক্ষতিপূরণ চাইতে গিয়ে ভাটা মালিকের কাছে হুমকি-ধমকি পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। যেন আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পীরগাছার বাতাস।

দীননাথ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘৩৬ শতক আবাদি জমি ছাড়া মোর কিছু নাই। ওটে চাষাবাদ করি সারাবছর খাও। এবার ঋণ নিয়া ধান নাগাছু। ধান ভালোই হছলো। কিন্তু সেই ধান মোর মমিনের ইটভাটার গ্যাসোত পুড়ি গেইছে। খড় ছাড়া কিছু নাই। ক্ষতিপূরণ চাবার গেইলে ওরা মোর পাও কাটি দেওয়ার হুমকি দেওছে। মুই কি খাইম, মুই কি করিম এ্যালা।’

জানা গেছে, শুধু দীননাথ চন্দ্র বর্মণ নয়; রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের বামন সর্দারপাড়ার মাঠে ৮০ জন কৃষকের ৪১ একর জমির বোরো ধান মমিনুল ইসলামের এমএসবি ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসের ঝলছে গেছে। নষ্ট হওয়া ধান খেতের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রশাসন ও ইটভাটা মালিকের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না কৃষকরা।

কৃষকেরা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে ওই ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে কৃষকদের ধানের ক্ষতি হয়। এ নিয়ে কৃষকরা রংপুর জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। বুধবার (২৯ এপ্রিল) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইটভাটা মালিক, কৃষি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা কয়েক দফা বৈঠক করেন। পরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ৮০ জন কৃষকের ৪১ একর জমির ক্ষতি নির্ধারণ করেন।

কয়েকদফা বৈঠকের পর শতক প্রতি ৫০০ টাকা হারে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে উপজেলা প্রশাসন। এ সময় মালিক পক্ষ এ টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) থেকে দুই দফায় ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। ফলে আজ দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণ ও ইটাভাটা মালিককে গ্রেপ্তারসহ ইট ভাটা উচ্ছেদের দাবিতে উপজেলা চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভাটার পাশের ধানখেতগুলো শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখে পাকা মনে হলেও সেগুলো পুড়ে যাওয়া। পাশেই ইটভাটায় মেডিকেল বর্জ্য, প্লাস্টিক ও পুরোনো জুতা পুড়িয়ে ইট তৈরি কাজ চলছে।

ওই মাঠে নিখিল চন্দ্র বর্মণের ৩০ শতক জমির ধান পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ধান খেত দেখিয়ে আক্ষেপ করে নিখিল চন্দ্র বলেন, ‘দাদা, মুই গরিব মানুষ, একনাই মোর সম্বল। তাক পুড়ি ছাই হইছে। ভাটার মালিক মমিন সাহেব ক্ষতিপূরণ দিবার চায়া খালি ঘুরাওছে। লাঠি-ছোরা নিয়া ঠেং ভাঙবার চায়। এখন মোর কি করার আছে।’

কৃষক সুশান্ত চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘সাড়ের তিন দোন (৮৪ শতক) জমির ধান ভাটার গ্যাসে নষ্ট হয়ে গেছে। ইটভাটার মালিক মমিন কোনো দায়ভার নেয় না। উল্টা বলে ধান নাগি মাজরা পোকা কাটছে। ভাটা মালিক মমিন বিএনপি নেতা হওয়ায় আমাদের ভয় দেখায়। এখন কোনটে গেলে আমরা সঠিক বিচার, ক্ষতিপূরণ পাব।’

আরেক কৃষক কফিল উদ্দিন বলেন, ‘কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য শতকে ৫০০ টাকা দেওয়ার জন্য ভাটা মালিককে বলেছে। কিন্তু ভাটা মালিক ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টা ইউএনওর কাছে আপিল করছে। এই ভাটার গ্যাসে এর আগে দুবার ফসল নষ্ট হইছে।’

পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি বিভাগের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তারা ঘটনাস্থল পরির্দশন করে ৪১ একর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রতিবেদন দিয়েছে। পরে ইউএনওর অফিসে ভাটা মালিক ও কৃষকদের উপস্থিতিতে ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়।’

জানতে চাইলে ইটভাটার মালিক মমিনুল ইসলাম মমিন বলেন, ‘কৃষি বিভাগ যে পরিমাণ জমি ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়েছে। প্রকৃত পক্ষ এত পরিমাণ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাই আমি ইউএনওর কাছে আপিল করেছি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কৃষকদের কোনো ধরণের হুমকি ধামকি দেইনি।’

ইটভাটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে রিট আছে। প্রশাসন এর আগে আমার ভাটায় জরিমানা করেছে। ইটভাটা চালাতে হলে প্লাস্টিক পোড়াতে হয়।’

এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ও কৃষকদের তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপুরণ নির্ধারণ করেছিল কৃষি বিভাগ। কিন্তু তা অতিরিক্ত দাবি করে ভাটার মালিক একটি অভিযোগ দিয়েছেন। সেটা পুনঃনির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হবে তা অবশ্যেই ভাটার মালিককে দিতে হবে।’

রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কমল কুমার বর্মণ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে একটি অভিযোগ এসেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ঢাকা বারের শোক, এজলাসে ওঠেননি বিচারকরা

বেগম জিয়ার জানাজা পড়াবেন যিনি

খালেদা জিয়াকে হারিয়ে কাঁদলেন বগুড়ার নেতাকর্মীরা

ফিফা বর্ষসেরা অনুষ্ঠানের পরবর্তী আসর দুবাইয়ে

বুধবারের জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা স্থগিত

নারীর জানাজা ও দাফন-কাফনের নিয়ম

ভিশনহীন কর্মী, করপোরেট খাতের নীরব ঝুঁকি

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে হেফাজতে ইসলামের শোক

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে চবিতে ক্লাস স্থগিত

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে মাভাবিপ্রবির ভাইস চ্যান্সেলরের শোক

১০

বাঁশ ঝাড়ের নিচ মিলল কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ

১১

যুবদল নেতাকে হত্যা

১২

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল

১৩

খালেদা জিয়ার তিন আসনের নির্বাচন নিয়ে আইন কী বলছে

১৪

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে মমতা ব্যানার্জির শোক প্রকাশ

১৫

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জাতি এক মহান অভিভাবককে হারাল : ১২ দলীয় জোট 

১৬

খালেদা জিয়ার কবর খোঁড়ার প্রস্তুতি চলছে

১৭

রংপুরের ছয় আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ৫৬ জন প্রার্থী

১৮

বিলিয়নিয়ারের তালিকায় বিয়ন্সে

১৯

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার অবদান মানুষ মনে রাখবে: মাশরাফী

২০
X