বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও, আত্মহত্যার মতো এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে এই জেলা এখন বিপন্ন। বিষয়টি নিয়ে জেলা পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের নেই কোনো সরকারি পরিসংখ্যান। কিন্তু মেহেরপুরের তিনটি থানা ও তিনটি সরকারি হাসপাতালে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এক ভয়াল চিত্র।
২০২৪ সালে জেলার তিনটি থানায় নথিভুক্ত হয়েছে ১১৯টি অপমৃত্যুর ঘটনা। এর মধ্যে ৫৯ জন গলায় ফাঁস দিয়ে এবং ২৯ জন বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। বাকিরা ঘুমের ওষুধ, উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়া বা অন্যান্য পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন।
চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত অপমৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৬-এ। এর মধ্যে ২২ জন আত্মহননের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফাঁস, ১৭ জন বিষপান করেছেন, বাকিরা অন্যভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়েছেন।
তবে যে চিত্রটি সবচেয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তৈরি করে, সেটি হলো আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের সংখ্যা। মেহেরপুরের তিনটি সরকারি হাসপাতালে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ২২৭, মুজিবনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫ এবং গান্ধীর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৯ জন, মোট ৩৬১ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে পাকস্থলী পরিষ্কারের জন্য ভর্তি করা হয়েছে। যারা কেউ ঘুমের ওষুধ, কেউ বিষ বা কীটনাশক খেয়েছেন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অন্তত ৪০ জন। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ১২ ঘণ্টায় একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এই জেলায়।
জেলা তথ্য অফিস দাবি করছে, তারা গত পাঁচ মাসে ৩২টি সচেতনতামূলক সভা ও ১৬টি নারী সমাবেশ করেছে।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সাউদ কবির মালিক বলেন, আমরা প্রতিদিনই আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের চিকিৎসা দিচ্ছি। কেউ বিষ পান করে, কেউ ঘুমের ওষুধ। বাঁচলেও তারা বাকি জীবন জটিল রোগে ভোগেন। কখনো কিডনি নষ্ট হয়, কখনো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান।
তিনি বলেন, অনেকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অনেক সময় ঘাড়ের হাড় ভেঙে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়, কেউ কেউ যদি বেঁচেও যান, তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে জীবিত থাকেন না।
জেলার থানা ও হাসপাতাল রেজিস্ট্রার বিশ্লেষণে দেখা যায়, আত্মহত্যার পেছনে কাজ করছে পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, এনজিওর ঋণের চাপ, সামাজিক বুলিং, বয়সজনিত অবহেলা এবং আর্থিক প্রতারণা। শিশুদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বাবা-মায়ের অবহেলা, স্কুলে সহপাঠীদের বুলিং এবং ছোটখাটো আবদার পূরণ না হওয়া। অনেকেই আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদায়ী বার্তা বা অভিযোগ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ তাদের প্রিয় জিনিস কাউকে দিয়ে দিয়ে গেছেন, যা আত্মহননের পূর্বাভাস হিসেবে ধরা পড়ে।
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আমিন বলেন, বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। বিনোদনের অভাব, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা, পরিবার থেকে দূরত্ব—সব মিলিয়ে তারা হতাশায় ভুগছে।
তিনি বলেন, আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চাপের কারখানা বানিয়ে ফেলেছি। সময় এসেছে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খেলাধুলার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করানোর। ধর্মবোধ ও নৈতিকতা বোধ জাগ্রত করা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আজাদ খান আত্মহত্যাকে কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখেন না। তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তি সমস্যা নয়। এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক এক বহুমাত্রিক সংকট। সময়মতো সহানুভূতির হাত বাড়ালে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব। আত্মহত্যার আগে বেশিরভাগ মানুষ সংকেত দেয় যেমন, আচরণে পরিবর্তন, চুপচাপ হয়ে যাওয়া, অতীত স্মৃতি নিয়ে কথা বলা, বারবার বিদায় ভাষ্য দেওয়া বা প্রিয় জিনিস অন্যকে দিয়ে দেওয়া। এই সংকেতগুলো যদি পরিবার, সহপাঠী বা সহকর্মীরা ধরতে পারতেন, তাহলে অনেক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতো।'
তিনি আরও বলেন, 'আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। স্কুল ও কলেজে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন চালু করা, কীটনাশকের অবাধ বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মহত্যা রোধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে। পরিবারে শিশু ও বয়স্কদের প্রতি যত্ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ এবং সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ফিরিয়ে আনতে না পারলে আত্মহত্যা শুধু বাড়বেই।'
মেহেরপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, 'ভৌগোলিক ও সামাজিক কারণে মেহেরপুরে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আমরা এরই মধ্যে কিছু স্কুলে কাউন্সেলিং শুরু করেছি, তবে এ বিষয়টি একা প্রশাসনের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটি স্তর—পরিবার, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ—সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।'
মেহেরপুরের আত্মহত্যার এই পরিস্থিতি নিছক পরিসংখ্যান নয়—এ এক মানবিক বিপর্যয়। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে এক একটি পরিবার, স্বপ্ন, সম্পর্ক ও সমাজ। সময় থাকতে সচেতন না হলে এই জেলায় একদিন হয়তো প্রতিদিনই কেউ না কেউ নিজেকে শেষ করে ফেলবে।
মন্তব্য করুন